#প্রণয়ের_ব্যাকুলতা
#সাদিয়া
#পর্ব_৩১
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
নাম না জানা ছেলেটা উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে তাজের হাতে গুঁজে দিল। বলল – আমার বিয়ের কার্ড। আমার বিয়েতে আপনার দাওয়াত রইল। অবশ্যই আসবেন। অপেক্ষায় থাকবো।
মৌমিতাকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। তাজ হতবম্ব হয়ে বসে আছে। মৌমিতাকে আটকানোর কথা মাথায় আসছে না একবারও। কি বলে গেল ছেলেটা। কার সাথে বিয়ে তার? মৌমিতার সাথে না তো? কলিজা কেঁপে উঠলো তাজের। অস্থির অস্থির লাগছে তাজের। মৌমিতাকে চলে যেতে দেখেই রাদীফ দৌড়ে এলো তাজের কাছে হাত থেকে ছো মেরে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে নিল। কার্ডটা খুলে ওলটপালট করে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল – ইসসসস কত দিন পর একটা বিয়ে খেতে পারবো। একদম কব্জি ডুবিয়ে খাব।
তাজ কটমট করে তাকালো রাদীফের দিকে, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – আমার বউয়ের বিয়ে হয়ে যাবে আর তুমি কব্জি ডুবিয়ে খাব? তোমার কব্জিই আমি কেটে নেব।
রাদীফ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো মিনিট খানেক অতঃপর কিছু একটা অনুমান করে বলল – এখানে কোনো বাংলা সিনেমা চলছে না যে তুই বিয়ের কার্ড না দেখেই বুঝে নিবি ঐ ছেলেটা তোর বউকে বিয়ে করছে। আর তুই বউয়ের শোকে দেবদাস হয়ে ঘুরবি।
তাজ চোখ ছোট ছোট করে রাদীফের দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাদীফ, বলল – ছেলেটার নাম সাফওয়ান। আর ছেলেটা যে মেয়েটাকে বিয়ে করছে তার নাম তানজিলা। এখানে বিয়ের কার্ডে লেখা আছে।
তাজ অবাক হলো বেশ। রাদীফের হাত থেকে বিয়ের কার্ডটা নিয়ে নিল তাজ ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিল কার্ডটিতে। নাহ রাদীফ ঠিক বলছে এখানে বরের নামের জায়গায় লেখা আছে সাফওয়ান হোসেন আর কনের নামের জায়গায় লেখা আছে মোসা : তানজিলা। তাজ অবাক চোখে কার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা যে বলল মৌমিতার বয়ফ্রেন্ড, মৌমিতাও তো তাই বলল। তাহলে এখন অন্য মেয়েকে বিয়ে করছে কেন? ওরা কি মিথ্যে বলেছে? আর যদি মিথ্যেই বলে থাকে তাহলে ছেলেটা কে? মৌমিতার সাথে তার কি সম্পর্ক?
– কোনো বয়ফ্রেন্ড যদি তার সামনে তার গার্লফ্রেন্ডের স্বামীকে দেখে তাহলে অবশ্যই এতটা স্বাভাবিক ব্যবহার করবে না যেটা সাফওয়ান করেছে। ডাক্তার এরিক কি তোর মাথা ঠিক করার সাথে সাথে মাথায় কতগুলো গোবর পুরে দিয়েছে যে এই সামান্য বিষয় বুঝতে তোর এতক্ষন লেগেছে। ওরা তোর সাথে মজা নিয়ে চলে গেছে গর্ধব।
________________________________
ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারপাশ। সকল বস্তু তার নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে বরন করে নিয়েছে কৃষ্ণ কালো অন্ধকারকে। রাত নেমেছে অনেকক্ষণ হলো। ঘড়ির কাঁটা রাত ২ টা ছুঁই ছুঁই। নিস্তব্ধ প্রাকৃতি, নিস্তব্ধ লোকালয়। সবাই বোধহয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের করুন সুর। আচ্ছা ওদের কন্ঠে এত করুন সুর কেন? ওদের এত কষ্ট কিসের? ওরাও মৌমিতার মতো , হৃদয়ের তীব্র দহনে জর্জরিত? হয়তো তাই। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মৌমিতা। কেন যেন অন্ধকারই বেশ ভালো লাগে তার। সেটাই যেন একমাত্র সঙ্গী তার। মনের মধ্যে ঝড়ো হাওয়া বইছে তার। কিছুই ভালো লাগছে না। কিছুতেই থামাতে পারছে না মনের মধ্যে তোলা ঝড়। ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। কেন দেড় বছর পর সেই পুরনো অতীত আবার সামনে এসে দাঁড়ালো তার। সেদিনের কথা মনে উঠলে, বাবার মৃত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলে ঘৃনা জন্মায় তাজের প্রতি। সেদিন যদি আর একটু আগে পৌঁছাতে পারতো তবে বোধহয় বাবাকে শেষবারের মতো একটু জীবিত দেখতে পারতো, শুনতে পারতো শেষ বারের মতো বাবার ঐ মিষ্টি কন্ঠস্বর। লোক মুখে শুনেছে বাবা নাকি শেষ মুহূর্তে শুধু ওকেই দেখতে চেয়েছিল। কাতর কন্ঠে বলেছিল – আমার সময় শেষ। আমি বুঝি আর বাঁচবো না। আমাকে শেষবারের মতো একটা বার আমার মেয়েকে এনে দেও। ওর মুখে শেষ বারের মতো একটা বার বাবা ডাক শুনি। ওই যে প্রথম আমায় বাবা ডাক শোনার সৌভাগ্য করে দিয়েছিল।
মৌমিতা পারেনি তার বাবার শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে। এর জন্য দায়ী তাজ, শুধুমাত্র তাজ। সে যদি সেদিন মৌমিতাকে আটকে না রাখতো তাহলে হয়তো সেদিন মৌমিতা একটু আগে পৌঁছাতে পারতো। শেষবারের মতো বাবা বলে ডাকতে পারতো। পূরন করতে পারতো তার বাবার শেষ ইচ্ছে। কিন্তু পারেনি। তাজকে সে কখনও ক্ষমা করবে না কখনও না।
সেদিন বাবার মৃত্যুর পর মৌমিতার বড় চাচা তাদের যশোরে নিয়ে আসেন। সাফওয়ান মূলত মৌমিতার চাচাতো ভাই। মৌমিতার চাচা এখানে ভালো পজিসনে আছে। এখানে এনে ওদের থাকতে দিয়েছিলো তাদের বাড়িতেই কিন্তু মৌমিতা থাকেনি। তারা কারো উপর বোঝা হতে চায় না। সম্পর্ক দূর থেকেই সুন্দর। কারো উপর অতিরিক্ত নির্ভর হয়ে পড়লে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ে। মৌমিতা চায় না তিক্ততা। বাবা নামক বটবৃক্ষ চলে যাওয়ার পর সংসারের সম্পূর্ণ দায়ভার এসে পড়েছিল মৌমিতার কাধে। একটা তিন রুম বিশিষ্ট মোটামুটি ধরনের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে মা ভাইকে নিয়ে থাকার জন্য। একটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছে। টিউশনি করছে কিছু, বাবার পেনশনের টাকা আসছে কিছু। সব মিলিয়ে চলে যাচ্ছে সংসার। জীবন কি অদ্ভুত তাই না, যে মেয়েটা নিজের পছন্দের কিছু কেনার জন্য বাবার কাছে টাকা চেয়ে কান্নায় গড়াগড়ি করতো সেই মেয়েটা দেড় বছর ধরে নিজের সংসারের দায়িত্ব বয়ে বেড়াচ্ছে। বাবা থাকতে কদর করে না অনেকেই। বাবা যখন থাকে না তখনই বোঝা যায় বাবা কি জিনিস। ছোট ভাইটাও বুঝতে শিখেছে । এখন আর সে আগের মতো বায়না ধরে না। পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী হয়ে উঠেছে। লুকিয়ে চুরিয়ে সেও টিউশনি করে দুই একটা। মৌমিতাকে জানতে দেয় না তাহলে সে বকবে। মৌমিতা চায় না এত তাড়াতাড়িই তার ভাই এই পৃথিবীর কঠিন নিয়মে বাধা পরুক। বাবার মতো হয়তো পারছে না কিন্তু সে চেষ্টা করছে সব দিক থেকে তার মা ভাইকে ভালো রাখার, বাবার অভাবটা তাদের বুঝতে না দেওয়ার। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মৌমিতার। আজ নিজের অতীতকে সামনে দেখে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছে না নিজেকে। হাজার হলেও ঐ মানুষটাকে একটা সময় ভীষণ ভালোবাসতো, হয়তো এখনও বাসে। তবে সেই ভালোবাসা তীব্র অভিমানের নিচে চাপা পড়ে গেছে।
__________________________________
গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে নাজেহাল প্রকৃতি। সূর্য যেন আজ রাগ করে পৃথিবীর উপর। একটু বেশিই তাপে ঝলসে দিচ্ছে সবকিছু। বেলা মাত্র এগারোটা কিন্তু মনে হচ্ছে যেন দুপুর। গরমে নাজেহাল মৌমিতা তবুও ৯ টা থেকে পরপর ক্লাস নিচ্ছে সে। একটু পরপর কপালের ঘাম মুছছে নিজের ওড়নায়। হঠাৎ ক্লাসের সামনে এসে দাঁড়ালো বিদ্যালয়ের পিয়ন। পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে বলল – বড় ম্যাডামে আপনারে ডাকছে।
ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার। এই সময় আবার হেড ম্যাডাম ডাকছে কেন? এখানে এসেই তো কথা হলো তার সাথে। তখন তো কিছু বলল না। ক্লাস মাঝপথে রেখেই ধীর পায়ে চলে এলো হেড ম্যাডামের রুমে। রুমে শুধু ম্যাডাম একা নয় আরও একজন আছে। শক্তপোক্ত পুরুষ মানুষ। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পিছন দিক থেকে দেখেই লোকটাকে চিনতে পেরেছে সে। এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার মানুষ নয় সে। তাজ প্রণয়ের রাজকুমার যে সে। তবে এই লোক এই সময়ে এখানে কি করছে? আর ভাবলো না মৌমিতা। কন্ঠে নম্রতা এনে বলল – মে আই কাম ইন ম্যাম?
হেড ম্যাডাম হেসে বলল – এইতো মৌমিতা চলে এসেছে। এসো এসো।
মৌমিতা ভিতরে চলে এলো। হেড ম্যাডামের আদেশে বসে পড়লো তাজের পাশের চেয়ারটাতেই। তাজ নরম চোখে তাকিয়ে আছে মৌমিতার মুখপানে। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। সকালে খেয়েছি কি মেয়েটা? গরমে কেমন ঘেমে নেয়ে গেছে মেয়েটা। নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে খুব। হেড ম্যাডাম কন্ঠে কিছুটা খারাপ লাগা এনে বলল – তোমার থেকে কিন্তু এটা আশা করিনি মৌমিতা। বিয়ে করে ফেললে অথচ আমাদের কাউকে জানালে না।
মৌমিতা একবার তাকালো তাজের দিকে তাজ এখনও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। এই লোকটা নির্ঘাত এখানে সবার কাছে মৌমিতার স্বামী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছে। মলিন হাসলো মৌমিতা, বলল – স্যরি ম্যাম আসলে সবটা একদম হুট করে হয়ে গিয়েছিল বলার সুযোগ পাইনি।
অবাক হলো তাজ। মৌমিতা খুব সহজেই তাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিল। তাজ ভেবেছিল মৌমিতা এত সহজে মেনে নিবে না তাকে । আরও নিজেকে এখানে এসে মৌমিতার স্বামী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার জন্য ক্ষেপে যাবে খুব। গতকাল মৌমিতার সাথে দেখা হওয়ার পরই সে মৌমিতার বিষয়ে খোঁজ নিয়েছে সব। এই বিদ্যালয়ের কথা জানতে পেরে চলে এসেছে এখানেই। তাজ আমতা আমতা করে বলল – যদি কিছু মনে না করেন মৌকে একটু ছুটি দিতে পারবেন? আমাদের একটু কাজ ছিল।
হেড ম্যাডাম হেসে বলল – এতে এত ইতস্তত করার কি আছে? আপনার বউ নিয়ে যান আপনি।
হেড ম্যাডামের কন্ঠে রসিকতা। কথা বাড়ালো না মৌমিতা। শান্তভাবে তাজের কথা মেনে নিল। বেরিয়ে এলো তাজের সাথে। তারও কথা বলা প্রয়োজন তাজের সাথে। গাড়িতে এসে সামনের সিটে বসলো দুজন। গাড়ি ড্রইভ করছে তাজ। সচরাচর ড্রাইভারই ড্রাইভ করে তাজের গাড়ি তবে আজ মৌমিতার সাথে দেখা করার জন্য নিজেই ড্রাইভ করে এসেছে সে, সঙ্গে রাদীফকেও আনেনি। মৌমিতা সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল – কোনো নীরব পাথরকে নিয়ে যান।
তাজ শুনলো মৌমিতার কথা। একটা শান্ত নীরব পার্কে নিয়ে এলো তাকে। এখানে জনসমাগম বা কোলাহল কোনোটিই নেই তেমন। ঘাসের উপর পাশাপাশি বসে পড়লো দুজনেই। মৌমিতা সামনের দিকে নজর রেখেই শান্ত কন্ঠে বলল – কেন আবার এসেছেন আপনি?
তাজ তাকালো মৌমিতার দিকে। মেয়েটার চোখে মুখে আগের মতো সেই চঞ্চলতা নেই। কেমন একটা পরিপক্ক ভাব এসেছে। দেড় বছরে অনেক পাল্টে গেছে মেয়েটা। তাজ নরম কন্ঠে বলল – তোমার টানে।
– কিছু টান রাখতে নেই পরে যন্ত্রনা হয়ে ধরা দেয়।
– তোমার টান যে আমার মৃত্যুতেও ঘুচবে না।
– তবে বারবার আপনাকে সহ্য নিতে হবে প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রনা।
– রাজি আছি আমি যদি শেষ অবধি তুমি আমার হও।
– আমি আর হবো না আপনার। আমি হারিয়ে গেছি অনেক আগেই ফিরবো না আর আপনার নীড়ে।
– ফিরতে যে তোমায় হবেই অন্তত আমার ভালোবাসার টানে ।
– কিসের ভালোবাসা? কোনো ভালোবাসা নেই আপনার আর আমার মধ্যে।
– ভালোবাসা তো বলে দেওয়ার জিনিস নয় যে তুমি বলবে ভালোবাসা নেই আর ভালোবাসা থাকবে না। ভালোবাসা সে থাকবে হয়তো প্রকাশ্যে নয়তো গোপনে।
চলবে….
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১০
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৮
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৭
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২১