সূচনা পর্ব
#তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
ছোট আপা বাড়িতে আসার পর থেকেই ভাবীর মুখ কালো। কথাবার্তা বলছে না। বিরক্তি নিয়ে ঘরের কাজকর্ম করছে। খানিক আগে ভাইয়ার সাথে তুমুল ঝগড়া করেছে। ভাইয়া তার কথার জবাব দেয়নি। সিগারেট হাতে বেরিয়ে গিয়েছে। মায়ের মুখখানাও কেমন থমথমে। সে একটু পরপর আপার ঘরে ঢুকছে, মিনিট খানেকের মধ্যে বেরিয়ে আসছে। মুখের অবস্থা আগের চেয়েও বিরস করে ফেলছে। বোধ করি বাড়িতে একটা কিছু হয়েছে।
আসল ঘটনা আমার জানা নেই। এই বাড়ির কোন ব্যাপারেই আমার মত খাটে না। কেউ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করে না। অনার্স পাশ করা বেকার ছেলের মতামতের গুরুত্ব সংসার জগতে নেই বললেই চলে। কথা না শুনে তিনবেলা ভাত গেলাও রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যাপার। সেখানে তিনবেলা খাবারের জন্য আমার কোন কথা শুনতে হয় না। ভাবী নিয়ম করে ভাত তরকারি বেড়ে দেয়। খারাপ কিছু দেয় না। ভালোটাই দেয়। সপ্তাহে দু’সপ্তাহে মাছের মাথা, মুরগির মাংস রাঁধলে পায়ের উপরের অংশ– এসবও আমার ভাগ্যে জোটে। তাই বাড়তি কথাবার্তার ভেতরে যাই না।
আজ সকালে এখনও খাবার জোটেনি। রান্নাঘর থেকে রুটি পোড়ার মিষ্টি গন্ধ আসছে। ঘড়িতে সকাল দশটার আশেপাশে। সকালের নাস্তা পেতে এত দেরি হয় না। আজ হচ্ছে। গলা বাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে উঁকি দিলাম। মা বললেন, “কী দেখছিস?”
হুড়মুড়িয়ে মায়ের দিকে তাকালাম। মেকি হেসে বললাম, “কিছু দেখছি না। খিদে পেয়েছে।”
মা আমার দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরের ভেতরে চলে গেলেন। ফিরলেন নাস্তার থালা হাতে। তিনটে রুটি, সবজি, ডিম পোঁচ। থালাটা টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, “মিনুর ব্যাপারটা একটু দেখবি?”
“ছোট আপার কী হয়েছে?”
“তুহিনের সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছে। ফিরবে না বলছে। গো ধরে বসে আছে। কোনভাবেই তাকে বোঝানো যাচ্ছে না।”
“ঝগড়া কী নিয়ে?”
“সে-সব কিছু বলছে না। শুধু বলছে– আমি আর ওর সাথে সংসার করব না।”
ছোট আপা খুব শান্ত মেজাজের মানুষ। ঝগড়াবিবাদের ধার ধারে না। কথায় মিললে কথা বলে, না হয় চুপ করে থাকে। ভাবী আসার পরেও প্রায় পাঁচ বছর এ বাড়িতে ছিল। তাদের মধ্যে সামান্য কিছুও হয়নি। কখনো গোমড়া মুখে কথা বলতে দেখিনি৷ বাকিদের সাথেও না। তুহিন ভাইয়ের সাথে আপার সম্পর্ক ভালো। যেনতেন ভালো না। চমৎকার ভালো।
মা কাঁধের পাশে ধাক্কা দিলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “কি ভাবছিস?”
“ছোট আপার হঠাৎ কী হলো সেটাই ভাবছি।”
“কাল রাত থেকে জিজ্ঞেস করছি। মুখ ফুটে কোন কথা বলছে না। দুই বছরের একটা ছেলে আছে। এই অবস্থায় কী কেউ নিজের সংসার ভাঙতে চায়?”
“আপা তো চাইছে।”
“সে কথাই তো বলছি। কেন চাইছে তা আবার বলছে না। তোদের এসব ঝামেলায় আমি পা’গ’ল হয়ে যাব।”
মায়ের দিকে তাকালাম। চোখের নিচে কালচে দাগ পড়ে গিয়েছে। বোধহয় রাতে ঠিকঠাক ঘুমতে পারেনি। মায়ের গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা। সামান্য কিছু হলেই চেহারায় ছাপ পড়ে যায়। মা করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি মায়ের দৃষ্টিতে গুরুত্ব দিলাম না। রুটি ছিঁড়তে ব্যস্ত হয়ে রইলাম। সবজিতে লবন কম হয়েছে। ভাবীর রান্না খুব ভালো। পারফেক্ট রান্না যাকে বলে। সবজিতে লবন কম হয়েছে মানে সে-ও দুশ্চিন্তায় আছে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ছোট আপার সাথে কথা বলতে হবে।
আমাদের বাড়িটা বেশ বড়। হেসেখেলে থাকার পরেও দু’টো রুম ভাড়া দেওয়া যায়। বাড়িতে ভাড়াটে তোলা বেশ ঝামেলায় বিধায় ওদিকে যাওয়া হয় না। রুম দু’টো ফাঁকা পড়ে থাকে। আপারা বেড়াতে এলে ওই রুমে থাকে। বড় আপা, ছোট আপার আলাদা রুম। দু’টো রুমের দরজার দুই রকমের পর্দা। বড় আপার রুমের পর্দা গোলাপি রঙের, ছোট আপার নীল। দরজার পর্দা টানা। মৃদু বাতাসে অল্প অল্প উড়ছে। আপা আমাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো না। সরল গলায় বলল, “কেমন আছিস? চাকরি বাকরি কিছু হলো?”
“চাকরি হয়নি। খুব যে চেষ্টা করছি তেমনও না।”
“ওহ আচ্ছা!”
“সকালে খেয়েছ?”
“না, এখনও খাওয়া হয়নি। তুই খেয়েছিস?”
“মাত্র খেলাম। ভাবীর রান্না তো জানো। আজ হঠাৎ সবজিতে লবন কম দিয়ে ফেলেছে। বোধহয় কোন কিছু দুশ্চিন্তা করছে।”
“হবে হয়তো।”
“সকালে ভাইয়ার চিৎকার চেঁচামেচি করছিল। তুমি কি কিছু জানো?”
“জানি না।”
আপা একটু ঝুঁকে জারিফের গায়ের কাঁথা টেনে দিলো। ছেলেটা ঘুমচ্ছে। ওকে দেখে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। খুব বেশি ভণিতা না করে বললাম, “মা বলছিল তুমি নাকি আর সংসার করবে না। তুহিন ভাইকে ছেড়ে দেবে। মাদার তেরেসা হতে চাও নাকি?”
আপা মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। অন্যরকম গলায় বলল, “মাদার তেরেসা হতে পারলে মন্দ হতো না।”
“সত্যি করে বল তো আপা– তোমার কী হয়েছে? তুহিন ভাই কিছু করেছে?”
“না। সে কিছু করেনি।”
“তাহলে তার কাছে ফিরবে না কেন? তোমাদের সম্পর্ক তো খুব ভালো।”
“ছিল।”
“ছিল বলছ কেন? এখন নেই?”
“না নেই।”
কথা বাড়ালাম না। বেরিয়ে এলাম। দরজা ভেজিয়ে দিতে দিতে বললাম, “সকালে খেয়ে নাও। জারিফ জেগে গেলে সুস্থভাবে খেতে পারবে না।”
আপা কথার জবাব দিলো না। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। মা দরজার পাশেই ছিলেন। বের হতেই হুড়মুড়িয়ে পড়লেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “তোকে কিছু বলল?”
“নাহ! কিছু বলেনি।”
মা পুরোপুরি ভাবে নিভে গেলেন। মরা গলায় বললেন, “মেয়েটার যে কী হলো! সবুর হুজুরের কাছে গিয়ে পানি পড়া আনতে হবে৷ বদ জ্বিনের আছড় হতে পারে।”
ঘড়িতে এগারোটা পঁয়ত্রিশ বাজে। এই সময়ে আমি বাড়িতে থাকি না। পার্কের বেঞ্চিতে বসে বাদাম খাই৷ ভাইয়া মাসের শুরু হাত খরচ দিয়ে রাখে৷ ওই টাকায় ত্রিশ দিনের বাদামের খরচ হয়ে যায়। আজ বের হতে দেরি হয়ে গেল। মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম। এক পলক তাকালাম মায়ের দিকে। তাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত মনে হচ্ছে।
বাইরে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। রাস্তাঘাট পু’ড়ে যাবে এমন অবস্থা। পার্কের বেঞ্চি ফাঁকা নেই। দু’টো ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসে আছে। ছেলেটা হাত নেড়ে নেড়ে কিসব কথা বলছে। মেয়েটা তার কথায় খিলখিলিয়ে হাসে। সেই হাসি দেখতে ভালো লাগছে না। লোক ভুলানো মিথ্যে হাসি মনে হচ্ছে। পার্কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। একটা কাজে যেতে হবে। এখন গেলে কাজ হবে না। দুপুরের খাওয়ার সময় যেতে হবে। মানিব্যাগ ভুলে রেখে এসেছি। হেঁটে যেতে হবে। বেশ অনেকটা পথ। রোদ মাথায় হাঁটতে আরম্ভ করলাম। নিজেকে সাহিত্য উপন্যাসের নায়কের মত মনে হচ্ছে। বেশিরভাগ বেকার যুবক রোদ মাথায় হেঁটে বেড়ায়। গল্প উপন্যাসে শুধু নয়, বাস্তবেও হাঁটে। চাকরির খোঁজে হাঁটে। টাকা সন্ধানে হাঁটে। তাদের পায়ে ব্যাথা হয় না। নাকি হয়?
তুহিন ভাই ক্যান্টিনের শেষ টেবিলটাতে বসেছে। সাথে একটা মেয়ে মানুষ। মেয়েটা পরনে চকচকে উগ্র পোশাক। মেয়েটা হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। একটু এগিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তুহিন ভাই আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। থলথলে গলায় বললেন, “তুমি এখানে?”
“ঘুরতে এলাম। ভাবলাম আপনার সাথে একবেলার খাবার খেয়ে যাই।”
“ওহ আচ্ছা! ভালো করেছ।”
“জ্বি ভালো করেছি।”
“দাঁড়িয়ে না থেকে বসো। বলো কী খাবে? কান্টিনের নতুন রাঁধুনি পাবদা মাছের ঝোলটা দারুণ রাঁধে। খেয়ে দেখবে নাকি?”
“খাওয়া যায়।”
তুহিন ভাই দুই প্লেট খাবারের অর্ডার দিলেন। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “অনুরিমা তুমি এখন যাও। খাওয়ার সময় বিরক্ত করো না। স্যারের সাথে কথা বলে তোমার ব্যাপারটা দেখব।”
মেয়েটি বেরিয়ে গেল। তুহিন ভাই বললেন, “অনুরিমার মায়ের শরীর খুব খারাপ। ছুটির প্রয়োজন। অফিসে কাজের খুব চাপ। বস ছুটি মঞ্জুর করছেন না। আমাকে ধরেছে। খুবই বিরক্তিকর!”
অল্প হাসলাম। খাবার চলে এসেছে। বড় সাইজের দু’টো পাবদা মাছ দিয়েছে। শসা কে’টে দিয়েছে। তুহিন ভাই বললেন, “গরুর গোশত খাবে? দিতে বলব?”
“বলুন। গরুর গোশত দিতে বলুন। পাবদা মাছের ঝোলটা বেশ ভালো। আরও একটা মাছ আনুন।”
তুহিন ভাই খাবারের অর্ডার দিলেন। মিনেমিনে গলায় বললেন, “তুমি হঠাৎ আমার কাছে এলে? কিছু কী হয়েছে?”
“কিছু হওয়ার কথা আছে নাকি?”
তার দিকে না তাকিয়েই কথাটা বললাম। তাকালে হয়তো দেখতাম– মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
“তেমন কিছু নেই। গতকাল তোমার আপা ওই বাড়িতে গেল। আর আজই তুমি এলে। তাই ভাবলাম ওদের কিছু হয়েছে কি-না।”
“কিছু হয়নি।”
খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলাম। তুহিন ভাইয়ের ভাবসাব খুব একটা ভালো ঠেকল না। মেয়েটার ব্যাপারেও একটু খোঁজ খবর করতে হবে।
দিনটা বেশ ব্যস্ততায় কাটল। মেয়েটার পুরো ডিটেইলস বের করে ফেলেছি। বিয়েসাদী হয়নি। মাকে নিয়ে ভাড়ার বাসায় থাকে। মায়ের শরীর ভালো না। চিকিৎসা চলছে। এই ধরনের মেয়েদের স্বভাব চরিত্র ভালো হয়। বিবাহিত পুরুষদের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর মত কাজ করতে পারে বলে মনে হয় না। তবুও মনের খচখাচানি মিটল না। আর একটু নজরে রাখতে হবে।
বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। মা ছোট আপার পিছনে লেগে আছে। আপা বিরক্ত মুখে মায়ের দিকে চেয়ে আছে কথার জবাব দিচ্ছে না। মা পরপর প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
“তুহিন কী তোকে কিছু বলেছে?”
“তুহিনের কী কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে?”
“তুহিনের মা বাবা কিছু বলেছে?”
ছোট আপা নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। জারিফ কাঁদছে। সেদিকেও খেয়াল দিচ্ছে না। ভাবী রান্নাঘরে কিসব কাজ করছিল। হাতের কাজ ফেলে এসে জারিফকে কোলে তুলে নিলো। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “ছেলেটা কাঁদছে। দেখতে পাচ্ছো না?”
মা বললেন, “ছেলের দিকে কী কোন নজর আছে? মাথায় কোন ভূত উঠেছে কে জানে?”
ভাবী আপার দিকে তাকাল। নরম গলায় বলল, “থাকুক না আম্মা। ওকে একটু নিজের মত থাকতে দেন।”
“নিজের মতোই তো আছে। কথাবার্তা বলছে না। প্রশ্ন করলে উত্তর দিচ্ছে না।”
মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর ভাবীর পিছনে বেরিয়ে গেলেন। ছোট আপা বলল, “ভাই, আমার পাশে একটু বোস।”
আমি আপার পাশে বসলাম। আপা বলল, “তুহিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি কেন?”
“একটু কাজ ছিল। কেন? তুহিন ভাই তোকে কিছু বলেছে?”
“না। বলেনি। তুই গিয়েছিলি– এতটুকুই বলেছে।”
“ওহ আচ্ছা। ওদের অফিসে আমার একটা কাজের কথা চলছে। সেজন্যই গিয়েছিলাম। পোস্ট ছোট। পিওনের কাজ। তবে বেতন ভালো।”
আপা চট করেই কিছু বলে বসল না। শান্ত চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। বরফ শীতল গলায় বলল, “তুই কী জানিস যে তুই মিথ্যে কথা বলতে পারিস না?”
মাথা দোলালাম। আপা বলল, “তোর চোখে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তুই মিথ্যে বলছিস। ঝামেলা করিস না ভাই। আমার সাথে কারোর কিছু হয়নি। তুহিনও কিছু করেনি। সংসার করতে ভালো লাগছে না। তাই সংসার করতে চাইছি না।”
“সংসার না করলে কোথায় থাকবে? কী খাবে?”
“এই বাড়িতে থাকব। এখানে আমারও ভাগ আছে। মা কিছু বলতে পারবে না। বড় ভাইয়াও কখনো কিছু বলবে না, ভাবীও না।”
“তা জানি। কিন্তু খাবে কী?”
“তুই রোজগার করবি। তোর টাকায় খাব।”
আমি একটু হাসলাম। আপাও খিলখিল করে হেসে ফেলল। ঝলমলে গলায় বলল, “ভাইয়া তোকে কখনো কিছু বলে না?”
“নাহ! কখনো কিছু বলে না। উল্টো হাত খরচের টাকা দেয়। মায়ের কাছ থেকে লুকিয়েই দেয়।”
আপা প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইছে। সে তুহিন ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। কিন্তু কেন চায় না? এই সমস্যা কত গভীর?
রাতের খাওয়া শেষ। জারিফ কাঁদছে। ভাবী জারিফকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। নানান ধরনের কথাবার্তা বলছে। ভাবীর ছেলেপুলে হয়নি। জারিফকে সে নিজের ছেলের মত ভালোবাসে। বড় আপার দুই ছেলেকেও বাসে। ভদ্রমহিলার কোন হিংসা-বিদ্বেষ নেই।
আড়মোড়া ভেঙে লম্বা হাই তুললাম। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়েছি। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। গায়ের উপরে পাতলা কম্বল। ঘুম ভালো হওয়ার কথা। ভালোই হলো। খানিকক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙল ফোনের রিংটোনে। অচেনা নম্বর থেকে কল আসছে। ঘড়িতে রাত দুইটার মত বাজে। কেমন একটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কল রিসিভ করব কি-না বুঝতে পারছি না। রাতবিরেতে অচেনা নম্বর রিসিভ করা বোকামি। সেই বোকামিই করে বসলাম। কল রিসিভ করলাম। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠ শোনা গেল। হন্তদন্ত হয়ে কথা বলছে। কিশোরীর মত রিনরিনে মিষ্টি গলা।
“নজু সাহেব বলছেন?”
“জ্বি। আপনি কে বলছেন?”
“আপনি আমাকে চিনবেন না। আগে-পরে আমাদের কথাবার্তা হয়নি। আজ দুপুরে হঠাৎ দেখা দেখা হলো। তুহিন স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।”
“অনুরিমা?”
“জ্বি আমি। আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন।”
“কী জন্য?”
“আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই। ভেবেছিলাম এসব কথা কাউকে বলব না। কিন্তু বলতে চাই। স্যারের স্ত্রী আপনার বোন হয়? উনার ব্যাপারেই।”
একটু ভড়কে গেলাম। মেয়েটা এসব কী বলছে। মাঝরাতে এই ধরনের কথাবার্তা মজা মশকরা হতে পারে না। নাকি পারে? আমায় চুপ থাকতে দেখে অনুরিমা বেশ কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলল। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললাম, “শুনছি।”
“আপনার দুলাভাই খুব ভয়ংকর পরিকল্পনা করেছে। আপনার বোনকে নিয়েই করেছে। আমাকেও মে’রে ফেলতে চায়। আজ রাতের মধ্যে আমাকে পালাতে হবে। হ্যালো! হ্যালো! আপনি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?”
“পারছি।”
“মাকে নিয়ে রাতের মধ্যে পালিয়ে যাব। যাওয়ার আগে আপনাকে সবকিছু বলে যেতে চাই।”
“বলুন।”
“ফোনে বলা যাবে না। দেখা করতে পারবেন?”
“কোথায় আসব?”
“বাসস্ট্যান্ডের দিকে আসুন।”
“আসছি।”
কল কে’টে গেল। অল্প হাসলাম। মেয়েটি আমাকে বোকা মনে করেছে। ভেবেছে ওর সব কথা বিশ্বাস করে নিয়েছি। রাত দুইটায় কোন বাস নেই। বাগেরহাটের দিকে অন্তত নেই। কিন্তু আমাকে এমন কেন বলল? তুহিন ভাইয়ের কথায়? নাকি অন্য কোন ব্যাপার আছে?
আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলাম। হাত মুখ ধুয়ে চর্ট লাইটটা কোমরের কাছে গুঁজে নিলাম। কেন ডেকেছে জানতে হবে। হুট করে কিছু হয় না। আমার নম্বর জোগাড় করা সহজ না। তুহিন ভাইয়ের ফোন থেকে চু’রি করেছে এই ব্যাপারটাও বিশ্বাসযোগ্য না। তাহলে?
রাতের আকাশ পরিষ্কার। চাঁদের আলো ঝলমল করছে। রাস্তাঘাটে লোকজন নেই। দু’টো কুকুর বসে বসে ঝিমচ্ছে। বাসস্ট্যান্ড খুব বেশি দূরে নয়। এত রাতে রিকশা পাওয়া যাবে না। হেঁটে যেতে হবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করল। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে ফেলেছি। ফোন বাজছে। অনুরিমা মেয়েটা আবারও কল দিয়েছে ভেবে ফোন বের করলাম। ছোট আপা কল দিচ্ছে।
“ভাই তুই কোথায়? এক্ষুনি বাড়িতে ফিরে আয়।”
“কি হয়েছে?”
“খুব বড় একটা সমস্যা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। দেরি করিস না।”
কল কেটে গেল। ব্যাক করতে গিয়ে দেখি– ফোনে চার্জ নেই। ফোনটাকে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। চার্জ শেষ হওয়ার আর সময় পেল না।
অনুরিমার কথা ভুলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। চাঁদের আলোর তীব্রতা বেড়েছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবকিছু।
সূচনা পর্ব
#তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
Share On:
TAGS: তখনও সন্ধ্যা নামেনি, ফারহানা কবীর মানাল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE