#আড়ালে_তুমি (সারপ্রাইজ পর্ব প্রথমাংশ)
#_সাইদা_মুন
-“বউ, বলোনা কি হয়েছে?”
-“কিছুনা…”
অফিস থেকে ফিরেই প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে সুমনাকে এই প্রশ্ন করেই যাচ্ছিল সাদ। তবু সে বলছে না মন খারাপের কারণ। এবার যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। তবে চিল্লাতে পারবে না, চিল্লালে কান্নাকাটি করে সুমনা গিয়ে বসবে শশুড়-শাশুড়ির কাছে। একে ওর জ্বালায় বাঁচা দায়, আবার তার বাবা-মা তিনজন মিলে একসাথে ধোলাই করলে বাপরে বাপ। ভাবতেই সাদের ভেতরের আত্মা যেন ফিসফিসিয়ে উঠলো,
-“ভাই, তুই মর, আমায় ফাঁসাস না। বউকে দরকার হলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল কর, কিন্তু কাঁদাস না। কান গেলে আমারই যাবে, তোর না।”
মুহূর্তেই নিজেকে শান্ত করলো সে। সুমনার দিকে তাকাতেই চোখ যেন হঠাৎ ঘোরে হারিয়ে যায়। হালকা খয়েরি রঙের শাড়ি পরিহিতা সেই প্রিয় মুখ- সুমনা, তার পূর্বপরিচিত প্রেমিকা। যাকে হারানোর ভয়ে লুকিয়ে বিয়েও করে ফেলেছিল। আজ সে আর লুকোনো স্ত্রী নয়, পরিবার-সমাজ সবাইকে জানিয়ে সসম্মানে ঘরে আনা বউ। ভাবতেই বুকের ভেতর এক অন্যরকম প্রশান্তি খেলে যায়। ঝগড়া-ভালোবাসার এই বাঁধনে কেটে গেলো এক বছর বিয়ের।
মুচকি হেসে সাদ এগিয়ে গেল। গাল ফুলিয়ে বসে থাকা গুলুমুলু বউটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নরম পেটে টান দিল। নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে কানের কাছে চুমু খেয়ে বিরবির করে বলল,
-“বউ, যাই করেছি সরি তো, আর করবো না।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই কানের উপর বাজ পড়লো যেন। সঙ্গে সঙ্গে সুমনা গর্জে উঠল,
-“কি করেছো সেটাই জানো না, আবার আদিখ্যেতা করতে এসেছো। একদম ঘা ঘেঁষে বসবে না, সরোওওওও…”
বেচারা সাদ রোমান্টিক মুডের আম্মাকে লাল সালাম জানিয়ে মুহূর্তে লাফিয়ে উঠে দূরে সরে গেল। বুক চাপড়ে থু থু দিতে দিতে মুখ ফসকে বলে ফেলল,
-“কি খন্নাস বউয়ের জন্ম দিলো শাশুড়ি। একটুর জন্য হার্ট…”
বাকি কথাটা গলাতেই আটকে গেল, সুমনার কড়া চোখ দেখে। ঢোক গিলে বলদের মতো হেসে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আবার মন খারাপের ভান করে বলল,
-“থাক, লাগবে না বলা। আমি তোমার কে? কেউই তো না, তাই এত অবহেলা…”
সুমনা এবার তেড়ে এসে গর্জে উঠল,
-“এই বেডা, কতবার বলেছি চিপস আনতে। আনলে না কেন? মনে ছিল না? তা থাকবে কেন, বাইরে গেলে ঘরের বউয়ের কথা মাথায় থাকে নাকি?”
সাদ অবাক হয়ে পিছিয়ে গেল। কবে বলেছিল সুমনা, মনে পড়ছে না। এমন তো হয় না, সব সময়ই তো মনে রেখে আনে নয়তো ঘরে যে ঘূর্ণিঝড় শুরু হবে তা তো জানেই। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল,
-“ইয়ে মানে বেবি, কখন বলেছিলে?”
সুমনা রাগী গলায় জবাব দিল,
-“ভয়েসে…”
সাদ যেন আবুল হয়ে গেল। ভয়েসে বলেছে সে। মোবাইলে অফিসিয়াল নোটিশ আসে প্রতি মিনিটে, এতকিছুর ভিড়ে কিভাবে খেয়াল করবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সঙ্গে সঙ্গে সেও একটি ভয়েস পাঠাল,
-“সরি বউ, ভয়েস শুনিনি। কাল থেকে ডিরেক্ট কল দিও, পাক্কা নিয়ে আসবো।”
এমন উত্তর দেখে সুমনা রেগে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদকে বিছানায় ধাক্কা মেরে চুল টেনে ধরতেই সাদ চেঁচিয়ে উঠল,
-“আম্মুউউউউ বাঁচাও, তোমার ভোলা বালা ছেলেকে মেরে ফেললো এই ডাইনি…”
সুমনা কটমট করে তাকাল, গালে জানের জুড়ে কামড় বসিয়ে তারপর ধপধপ পায়ে সেখান থেকে চলে গেল। সাদ তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে হালকা হেসে উঠল। এ ঝাসির রানিকে একটু পরেই সামলে নিবে, আপাতত রাগ করুক নাহয়। দিনের সিংহ সুমনা হলেও রাতের সিংহ তো সে। নিজেও চুল ঠিক করতে করতে বাথরুমে ঢুকে গেল।
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। টেবিলে সবাই বসে আছে। গিয়ে রুদ্রের পাশে বসল। তাহমিদের সাথে পড়ালেখা নিয়ে টুকটাক আলাপ চলছিল। সাদকে দেখে তাহমিদ গলা ঝেরে বলল,
-“ভাইয়া আজকাল কি তোমাকে বড়বড় মশা কামড় দিচ্ছে নাকি।”
সাদ নিজের গাল ঢাকতে ঢাকতে বলল,
-“মশা না রাক্ষস।”
এর মধ্যেই মেঘ আর সুমনা একে একে খাবার সাজাচ্ছে টেবিলে। সিদ্দিকা চৌধুরী আর তাহেরা চৌধুরী একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, আবার ভরতি চোখে ছেলেদের বউদের দেখছেন। মেঘ বিয়ের পর একাই সব সামলাতে চাইলেও তারা পাশে থাকতেন, তবে সুমনা আসার পর যেন দু’ঝায়ের শক্তি বেড়ে গেছে। এখন তো শাশুড়িদের রান্নাঘরে ঢোকার পারমিশনই নেই।
-“আমার চুল কি পেকে গেছেরে, ছোট?”
তাহেরা বেগম হেসে উঠলেন। প্রতিদিনের এই প্রশ্নে তাঁর অভ্যস্ত জবাব,
-“না ভাবি, এখনো কালোই আছে।”
সিদ্দিকা বেগম মুচকি হেসে বললেন,
-“মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি, বসে বসে খাই।”
পাশ থেকে মেঘ খাবার বাড়তে বাড়তে বলল,
-“কম তো আর সংসার সামলাননি আপনারা। এবার একটু শুয়ে বসেই খাবেন।”
সুমনাও তাল মিলিয়ে বলল,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদেরও শশুড়-শাশুড়ির সেবা করার সুযোগ দিন। নাকি আমরা বেশি সওয়াব কামাচ্ছি দেখে আপনাদের জ্বলছে হুম?”
কথায় মুহূর্তেই হাসির রোল উঠল। তাহমিদ পাশ থেকে পিঞ্চ মেরে বলল,
-“ভাবি, আমাকেও একটু সওয়াব ফিক্কা মেরে দিও।”
সুমনা কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
-“এহহ সরকারি নাকি? তবে ঘোষ হিসেবে কিছু মিছু দিলে দিতে পারি।”
সবাই মিটিমিটি হাসছে। কথোপকথনের মাঝেই রুদ্রের দাদির মুখে ফুটলো সুখময় হাসি। পরিবার যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুই মেয়ে গেছে, আবার দুই মেয়ে এসেছে। সুখের শেষ নেই, হাসি-ঠাট্টায় মুখর পরিবেশ। প্রাপ্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন,
-“আল্লাহ যেন এই পরিবারের বন্ধন এভাবেই অটুট রাখেন। এখন শুধু তাহমিদ দাদু ভাইটাকে সুখে দেখে মরলেও শান্তি পাব।”
কথায় পাশ থেকে তাহমিদ দাদির গাল টেনে নিয়ে দুষ্টুমিতে বলল,
-“বুড়ি, আমার মেয়ের জন্মদিনে তোমাকে আর আমার মেয়েকে একই রকম পুতুল সাজাবো। তার আগে কোথাও যেতে দিচ্ছি না, বুঝলে?”
তিনি হেসে ফেললেন,
-“কারো হায়াত-মউতের কথা বলা যায় না রে দাদু ভাই। কার কখন কি হয়, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।”
রুদ্র কপট রাগে বলল,
-“বুড়ি, আবার শুরু করলে? বলিনি এসব কথা মুখে না আনতে? আমাদের সাথে থাকতে ভালো লাগে না, চলে যেতে চাও বারবার?”
সাদ পাশ থেকে টিটকারি মেরে বলল,
-“জামাইকে মিস করছো বুঝি? দ্যাখো, এক জোয়ান দাদা দেখে তোমাকে আবার বিয়ে করিয়ে দেবো। তখন আর কোথাও যেতে চাইবে না।”
নাতিদের কথায় তিনি হেসেই যাচ্ছিলেন। পিহু আর সামিয়াকে খুব মনে পড়ছিল তাঁর। থাকলে তারাও এখন মেতে উঠত এই হাসি-ঠাট্টায়। হেসে বললেন,
-“হয়েছে হয়েছে, যাচ্ছি না কোথাও তোদের ছেড়ে। শোন রে সামিয়া, পিহুর জন্য মনটা ভীষণ টানছে। কাল জামাইসহ ডেকে আনিস, ক’দিন থাকুক এখানে।”
এনামুল চৌধুরী সায় দিলেন,
-“আমিও তাই ভাবছিলাম। অনেকদিন হলো আসেনি। আজকেই কল দেবো।”
এরশাদুল চৌধুরী উঠে বললেন,
-“আচ্ছা, এবার মেঘ-সুমনা বসো মা। এখানে সবই আছে, আমরা নিজেরাই নিয়ে খেতে পারব। এখন একটু ছেলে-মেয়েদের নিয়ে শান্তিতে খেতে দাও, বসো বসো।”
মুচকি হেসে মেঘ-সুমনা বসে পড়ল টেবিলে। এভাবেই হাসি-আনন্দের সঙ্গে শেষ হলো রাতের খাওয়া-দাওয়া। চৌধুরী বাড়ি এখন আগের চেয়ে আরও প্রাণবন্ত। বাচ্চা না থাকলেও সুমনার দুষ্টুমিতেই বাড়ি মাতিয়ে রাখে। সঙ্গে তাহমিদের সঙ্গ। মেঘের সবার জন্য ঢাল হয়ে থাকা, ভাইদের একজোট হয়ে সংসার সামলানো, সব মিলিয়ে যেনো ঘরের কর্তাদের আসলেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে তারা।
–––
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মেঘ সবে মাত্র রুমে প্রবেশ করেছে। ঢুকতেই রুদ্রের গম্ভীর চেহারাটা চোখে পড়ে। সকাল থেকেই রেগে আছে রুদ্র। তার একটাই কারণ, দু’দিন ধরে শরীরটা খারাপ দিচ্ছে অথচ মেঘ কিছুতেই ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হচ্ছে না। মুহূর্তেই মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে। দরজা লাগিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় রুদ্রের দিকে। তবে রুদ্র যেন তাকে দেখেও না দেখার ভান করে ল্যাপটপে কাজ করতে ব্যস্ত।
মেঘ মুচকি হেসে আলমারি থেকে একটা রানি-গোলাপি শাড়ি বের করে। সেটাই রুদ্র ক’দিন আগে তার জন্য এনেছিল। পড়ার সুযোগ হয়নি, আজ তাই নিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায়। সুন্দর করে শাড়িটা পরে বেরিয়ে আসে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে গুছিয়ে নেয় নিজেকে।
অতঃপর একটা ছোট ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়ায় রুদ্রের ঠিক সামনে। তবু রুদ্র তার দিকে তাকায় না। মেঘ সেটা দেখে ল্যাপটপটা আলতো করে রুদ্রের উরু থেকে সরিয়ে নিজে বসে পড়ে তার কোলে। গলা জড়িয়ে রুদ্রের চোখে চোখ রাখে। নরম কণ্ঠে বলে,
-“এমন করছেন কেনো, আপনার এমন চুপচাপ থাকা ভালো লাগছে না আমার।”
রুদ্র গম্ভীর মুখে উত্তর দেয়,
-“এসব করে লাভ নেই, আমি গলছি না। যে আমার কথা শুনে না, তার দিকে তাকানোরও ইচ্ছে নেই আমার।”
-“আমি সত্যি ঠিক আছি।”
রুদ্র আর কিছু বলে না। শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে মেঘের দিকে। মেঘ আস্তে আস্তে বলতে থাকে,
-“আমি না আপনার থেকে একটা জিনিস লুকিয়েছি।”
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-“কি..?”
-“এতে সেই লুকানো জিনিস আছে।”
মেঘ হাতের ছোট ব্যাগটা রুদ্রের হাতে দেয়। রুদ্র কপাল কুঁচকে খুলতেই থমকে যায়। তার হাত যেন আটকে যায় ভেতরের জিনিসগুলো দেখে, মনে হয় অদৃশ্য কোনো ভার বহন করছে।
-“কি হলো, বের করুন।”
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছটফট নয়নে তাকায় রুদ্র মেঘের দিকে, আবার ব্যাগের দিকেও। তার হাত কাঁপতে থাকে। অবিশ্বাসে ভরা চোখ, কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করে,
-“ব..বউ এটা স্বপ্ন, এটা স্ব…প্ন নয় তো?”
মেঘের ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। মাথা নেড়ে বোঝায় ‘না’। রুদ্র কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে দ্রুত ব্যাগ থেকে বের করে আনে ছোট ছোট জামা-জুতো। সাথে একটি কাগজ, তাতে লেখা,
“I’m coming my dear papa, are you waiting for me?”
রুদ্র আর কিছু ভাবতে পারলো না। মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই, কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সুখবর পেয়ে তার পক্ষে আর চোখের বাঁধ ভাঙা আটকানো সম্ভব হয় না। মাথা তুলে মেঘের মুখ দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বলে,
-“তুমি একবার বলো… তুমি একবার মুখে বলো…”
মেঘ ভেজা কণ্ঠে সেই সুখকর সংবাদ শোনায়,
-“আমার প্রিয় রুদ্র মশাই, আপনি বাবা হতে চলেছেন, আর আমি মা। আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন আসতে চলেছে এ দুনিয়ায়।”
রুদ্রের খুশি ধরে কে! সে তো লাফিয়ে উঠে মেঘকে কোলে নিয়ে ঘুরতে থাকে, যেন ছোট্ট শিশুকে প্রিয় খেলনা কিনে দেওয়া হয়েছে আর সে আনন্দে আত্মহারা। একের পর এক চুম্বনে ভরিয়ে দেয় মেঘকে,
-“বউ তুমি কি জানো, আমার জীবনের সেরা উপহারটা তুমি আমাকে দিতে যাচ্ছো। আমি…আমি কিভাবে যে বলি কতোটা খুশি। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি বাবা হবো… আমি বাবা।”
রুদ্রের এসব বাচ্চামি পাগলামিতে হেসে ওঠে মেঘ। সেও ভীষণ খুশি। গতকাল পিহুর কথায় সে যখন প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে, তখনই পজিটিভ আসে। তারপর থেকেই ভেতরে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। যেন তার শরীরের ভেতরে নতুন একটা প্রাণ নীরবে শ্বাস নিচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকেই হঠাৎ অপরিচিত মনে হয়। মনে হয়, সে শুধু ‘সে’ নয়, সে এখন দুজন। চোখের কোণে আনন্দাশ্রু জমে ওঠে, বুকের ভেতর শিহরণ বয়ে যায়। মনে হয়, শরীরের প্রতিটা ধমনীতে যেন বাজছে এক অদ্ভুত সুর, মায়ের প্রথম গান, সন্তানের প্রথম আশ্রয়।
হঠাৎ রুদ্র থেমে যায়। তাড়াতাড়ি মেঘকে বিছানায় বসিয়ে রাগভরা স্বরে বলে,
-“শিট! স্টুপিড আমি, এই অবস্থায় তোমাকে কোথায় সাবধানে রাখতে হবে।”
মেঘ হেসে তার হাত ধরে পাশে বসায়। সেদিন সারা রাত দু’জনের কাটে গল্পে গল্পেই। মাঝে মাঝে রুদ্র মেঘের পেটে মাথা রেখে বাবুর সাথে কথা বলে। যদিও বাচ্চাটা তখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, তবু বাবার মন তো। দু’জন মিলে কল্পনার জাল বুনতে থাকে, এ ছোট্ট অদেখা প্রাণ কেমন করে হাঁটবে, কেমন করে হাসবে, কাকে প্রথম ডাকবে। তাদের মনের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে অসংখ্য স্বপ্ন।
এরই মধ্যে রুদ্র সবাইকে খবরটা জানাতে চাইলে মেঘ থামায়। বলে, কাল সবাই একসাথে হলে তখনই বলবে। রুদ্র বাধ্য ছেলের মতো বউয়ের কথাই মানে। মেঘকে বুকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-“এখন মনে হচ্ছে শুধু তোমাকে নয়৷ তোমার সাথে বাবুকেও বুকে নিয়ে আছি। আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া, এত সুন্দর একটা অনুভূতি দেওয়ার জন্য।”
পরক্ষনেই আবার রুদ্রের হাসি মিলিয়ে যায়,
-“তবে সামনের দিনগুলোর জন্য ভীষণ ভয়ও হচ্ছে।”
-“ভয়ের কি আছে?”
রুদ্র মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনমরা স্বরে বলে,
-“বাচ্চা জন্ম দেওয়া কি এত সহজ। এই ৯টা মাস তোমাকে কত কষ্ট করতে হবে, সেই ভেবেই ভয় হচ্ছে।”
মেঘ হেসে বলে,
-“এই কষ্ট কিছুই না। প্রত্যেকটা মা হওয়ার পেছনে এই দিনগুলো থাকেই। কথায় আছে না, কষ্ট করলে কেষ্ট মিলে। আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন, তাহলেই হবে।”
রুদ্র মেঘের মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই প্রথম দিনের দৃশ্য। বেবি-পিংক রঙের চুড়িদার পরা সেই ভীত-সন্ত্রস্ত, হেঁচকি তোলা মেয়েটি। ড্যাপড্যাপ চোখ মেলে ভয় নিয়ে তাকিয়েছিল ঠিক রুদ্রের দিকেই। সেই অপরিচিতা আজ তার সন্তানের মা হতে চলেছে। সময় কত দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। আবারও মেঘের সমগ্র মুখমণ্ডল চুম্বনে ভরিয়ে দিলো রুদ্র। পরম স্নেহে তার চুলে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বলল,
-“ভালোবাসি বউ, ভীষণ ভালোবাসি… ভালোবাসি আমার রোদেলার আম্মুকে।”
মেঘ মুচকি হেসে উত্তর দিল,
-“রোদেলা? যদি ছেলে হয়?”
-“তাহলে শেহরোজের আম্মু।”
মেঘ কপাল কুঁচকে বলল,
-“না না, রুদ্রান রাখব।”
-“তাহলে শেহরোজ চৌধুরী রুদ্রান, আর মেয়ে হলে রোদেলা চৌধুরী মেহু।”
সে রাত দু’জনের জীবন পরিণত হয় ভীষণ আনন্দের এক অবিস্মরণীয় রাতে।
–––
অন্যদিকে ভূঁইয়া বাড়িতে,
পিহু কোমরে ওড়না বেঁধে রান্নায় ব্যস্ত। ফারহানের মা একটু পর পর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন, তবে পিহু তাকে রান্নাঘরে আসতে কড়া মানা করেছে। এমনিতেই শরীর খারাপ, তার ওপর আগুনের তাপে আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ফারহান সবে মাত্র বাসায় ফিরল। মাকে এভাবে দাঁড়িয়ে উঁকি দিতে দেখে কপাল কুচকে এগিয়ে এল।
-“কি ব্যাপার আম্মু, ভেতরে কে? এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?”
ছেলের কণ্ঠ শুনে মা ঘুরে তাকালেন। চোখ-মুখ ছোট করে মৃদু অভিমানী সুরে বললেন,
-“কি আর করবো। ঘরে আছে না আমার মা , মনে হয় শাশুড়ির রূপে ইনিই হাজির হয়েছেন। সারাক্ষণ শাসনে রাখে। এখন আবার ঢুকতেও দিচ্ছে না রান্নাঘরে।”
ফারহান মায়ের কথা শুনে হেসে উঠল। বেশ বুঝতে পারছে, পিহুর কথাই তিনি বলছেন। কাছে টেনে এনে সোফায় বসিয়ে দিল,
-“ঠিকই তো করছে। তুমি অসুস্থ, একটু রেস্ট তো নাও।”
-“আমি এখন একদম ভালো আছি। দেখ, মেয়েটা একা একা কি না করছে। নতুন রান্না শিখেছে, এখনো পাক্কা রাধুনি হলো কিনা সন্দেহ। সারাটাও অসুস্থ, তার ওপর তোর চাচি গেছে বাপের বাড়ি। ও একা এতোজনের রান্না করবে কি করে? উল্টো হাত পুড়িয়ে বসবে।”
ফারহান উঠে দাঁড়াল,
-“চিন্তা করোনা, আমি আছি। তুমি রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও।”
বলেই মাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেও কাপড় বদলে সোজা রান্নাঘরে ঢুকল। চোখ পড়তেই গৃহিণীর রূপে পিহুকে দেখতে পেল। চুল খোপায় বাঁধা, কপালে সামনের কাটা চুলগুলো নেমে এসেছে। কোমরে পেচানো ওড়না, এক হাতে তরকারি নাড়ছে, আবার সবজি কাটছে। মনোযোগের দুনিয়ায় যেনো একেবারে হারিয়ে আছে।
ফারহানের ঠোঁটে জয়ের হাসি ফুটে উঠল। যেনো জীবনের বড় কিছু অর্জন করেছে সে। সেই অবুঝ, বাচ্চামি করা, দুষ্টু আর বেয়াদব পিহু আজ দায়িত্ববান বধূ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঘামভেজা গলায় মুখ ডুবিয়ে দিল।
হঠাৎ স্পর্শে পিহু চমকে উঠলেও মুহূর্তেই বুঝল এ ফারহান ছাড়া আর কেউ নয়। এক হাতে তার গাল ছুঁয়ে ঠোঁটে একফোঁটা হাসি খেলে গেল,
-“কি মশাই, কখন এসেছেন?”
ফারহান তাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে গলায় টানা দু’টো চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“যখন আপনি কাজে ব্যস্ত ছিলেন।”
-“তো এই গরমে এসেছেন কেনো? যান, ফ্যানের নিচে বসুন। আমি শরবত করে আনছি।”
ফারহান তার গলায় হালকা কামড় দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল,
-“তার দরকার নেই।”
বলতে বলতেই তার হাত থেকে চাকু কেড়ে নিয়ে নিজেই সবজি কাটা শুরু করল। পিহু বিস্ময়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল। সঙ্গে সঙ্গে ছুরি ছিনিয়ে নিতে হাত বাড়াল,
-“কি করছেন? দেন আমাকে, আমি করে নিই।”
-“উহু, আমি কাটতে পারবো…”
-“আরে, সারাদিন পরে এসে এসব কি লাগিয়েছেন? একটু রেস্ট নিন না। রান্না প্রায় শেষ, শুধু সবজিটা বাকি। আমি করে নিবো।”
কিন্তু ফারহান নাছোড়বান্দা। সাহায্য করবে মানে করবেই। অবশেষে পিহু আর আটকায়নি। সে কেটে যাচ্ছে, আর পিহু রান্নায় মন দিয়েছে। মাঝেমধ্যে আড়চোখে ফারহানকে দেখছে পিহু।
রাগচটা, গম্ভীর যে মানুষ একসময় তাকে অগ্রাহ্য করত, আজ সেই মানুষ তার জন্য রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। মনের ভেতর অচেনা এক শান্তিময়, সুখকর বাতাস বয়ে গেল।
রান্না প্রায় শেষের পথে। ফারহান বাসনপত্র ধুয়ে গোছাচ্ছে, যদিও পিহু তাকে এসব করতে দিচ্ছে না। তবু সে নিজের মতো করে যাচ্ছে।
এমন সময় পিহু তরকারির ঢাকনা খুলে লবণ টেস্ট করতে মুখে নিতেই ঘ্রাণ নাকে লাগতেই তার চোখ-মুখ কুচকে গেল। তড়িঘড়ি মুখ চেপে সোজা ভেসিনের কাছে গিয়ে গলগলিয়ে বমি শুরু করল।
হতভম্ব হয়ে ফারহান ছুটে এল।
-“এই পিহু, কি হলো তোমার? মাত্রই তো ঠিক ছিলে।”
বমি থেমেছে, কিন্তু শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফারহানের বুকে হেলে বলল,
-“বুঝতে পারছি না। ঠিকই তো ছিলাম। তরকারির ঘ্রাণ আসতেই যেনো সব গুলিয়ে উঠলো।”
ফারহান আর দেরি না করে তাকে কোলে তুলে সরাসরি রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
-“চুপচাপ রেস্ট নাও…”
-“কিন্তু রান্না…”
-“তা আমি শেষ করছি। এই গরমে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলে বলেই এমন হলো।”
তারপর রান্নাঘরে ফিরে বাকি কাজ কোনোরকমে গুছিয়ে শেষ করল। খাবার নিয়ে এসে নিজ হাতে পিহুকে খাওয়াতে লাগল।
পিহু নিরবে তাকিয়ে আছে তার প্রিয় মানুষটার দিকে। কেনো এতো ভালোবাসে সে তাকে? প্রশ্ন করে মনে মনে নিজেকেই উত্তর দিল, এই যে এতটা যত্নে রাখে, ছোট বাচ্চার মতো আগলে রাখে, এই ছোট ছোট কারণেই তো ভালোবাসা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে।
কিন্তু খাওয়ার মাঝেই পিহুর আবারও বমি করে । ফারহান ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ল,
-“এই বউ, এখনই ডাক্তার কাছে যাই চলো।”
-“আরে না, রাত অনেক হয়েছে। হয়তো ফুড পয়জনিং হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
-“কিন্তু…”
-“কোনো কিন্তু না, আগে আপনি খেয়ে নিন। আমি বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
ফারহান আর কিছু বলল না। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে শুয়ে পড়ল পিহুর পাশে। নিজের বুকের কাছে টেনে নিল শক্ত করে। পিহুও আবেশে জড়িয়ে ধরল তাকে। এখানেই যেনো সব সুখ আর শান্তি মিলেমিশে একাকার।
ফারহান পরপর কয়েকবার ঠোঁট ছোঁয়াল তার কপালে।
-“তুমি বড্ড অবাধ্য বউ।”
পিহু হেসে উত্তর দিল,
-“আপনারই তো…”
আরও শক্ত করে জড়িয়ে অধিকারী কণ্ঠে ফারহান বলল,
-“হুম, তুমি শুধু আমার, একান্তই আমার।”
একটু থেমে পিহুর কানে ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“তুমি আমার বেয়াদব বউ, আমার অবাধ্যনারী, আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার ভালোবাসা, আমার বর্তমান, আমার ভবিষ্যৎ, আমার জীবন, আমার সব।”
পিহুর ঠোঁটে ফুটল যুদ্ধজয়ের হাসি। নতুন কিছু নয়, ফারহান প্রায়ই এভাবে বাচ্চামি করে। তবে পিহুর ভীষণ ভালো লাগে এসব। আজও তাকে সেই প্রথম দিনের মতোই ভালোবাসে ফারহান, একটুও বদলায়নি।
পিহু তার ভাবনায় ডুবে আছে। হঠাৎ ফারহান খোঁচা দিয়ে বলল,
-“মনে আছে ইমরান হাশ…”
পিহু চোখ বড় করে তাকিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিল। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলল ফারহানের বুকে। আজও সেই দিনের কথা মনে পড়লে শিউরে ওঠে সে। ফারহান হাসতে হাসতে বলল,
-“তবে যাই বলো, তার জন্যই তো বিয়েটা দ্রুত হয়েছিল।”
পিহু রাগী চোখে তাকালেও ফারহান চুপ করে গেল, তবে ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি লেগেই আছে। আর পিহু স্মৃতিতে ফিরে গেল সেদিনের।
২ বছর আগে,
মেঘ, সুমনা, রিক, পিহু ভার্সিটির ক্লাস ফাকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশেই এক আম বাগানের গেটের বাইরে। তাদের বর্তমান পরিকল্পনা, আম চুরি করা। গেটের কাছে পাহারায় দাঁড়িয়ে আছে এক বুড়ো লোক। ভেতরে ছোট একটি বাড়ি, সম্ভবত লোকটি সেখানেই থাকে। পিহু সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, কে কী করবে। যদিও মেঘ এসবের মধ্যে থাকতে চাচ্ছিল না, তবু তাকে দেওয়া হলো সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
-“কিইইই আমি নাই বাবা, মাফ কর।”
-“না না, প্লিজ জানু, এমন করিস না।”
-“নাহ, আমি যাচ্ছি, থাক তোরা।”
-“ছীইই, এই বুঝি ফ্রেন্ডশিপ। হাহ, মানুষের ফ্রেন্ডও দেখি, আমার ফ্রেন্ডও দেখি। মানুষের ফ্রেন্ড জান দিতে রাজি, আর আমারটা সামান্য কথা শুনতে রাজি না।”
পিহুর কথায় মেঘ কটমট করে তাকায়, তেড়ে এসে পেটে গুতা মেরে বলল,
-“নাটক কম কর, পাপিরদল।”
পাশ থেকে রিক, সুমনাও অনুরোধ শুরু করে। শেষমেষ মেঘ রাজি হয়। এদের সাথে সে কখনোই পারেনা। সবাই গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে গাছের আড়ালে। মেঘ আস্তে ধীরে এগিয়ে যায় লোকটার দিকে,
-“আসসালামুআলাইকুম, দাদা।”
লোকটা মেঘকে দেখে কিছুক্ষন ব্রু কুচকে তাকায়। তারপর এগিয়ে আসে,
-“ওয়ালাইকুম আসসালাম, কি চাই?”
মেঘ আমতা-আমতা করে একবার তাদের দিকে তাকায়, তারা চোখ গরম করে ইশারা করতেই বলতে লাগে,
-“আমাদের দুই হাতে আঙুল কয়টা জানেন?”
লোকটা কিছুটা অবাক হয়, এ কেমন প্রশ্ন? এমন সমন এমন প্রশ্নই বা কেনো মতলব কি ভেবে সন্দেহভরে জিজ্ঞেস করল,
-“জানি তো, দশটা।”
-“তাহলে আপনি ভুল জানেন, দশটা না, এগারোটা।”
-“কিই, মাথা খারাপ নাকি। এই যে দেখো, দশটা।”
বলেই লোকটা গুনে দেখায়। তা দেখে মেঘ থামিয়ে নিজের এক হাত দেখিয়ে বলল,
-“না, এভাবে না, আমার ডান হাতে কয়টা আঙুল?”
-“পাঁচটা।”
এবার মেঘ সেই হাতের চারটি আঙুল নামিয়ে, বুড়ো আঙুল তুলে রাখে, সাথে অন্য হাতের পাঁচ আঙুলও তুলে সামনে ধরে,
-“আর এখানে কয়টা আঙুল?”
লোকটি হিসাব করে বলল,
-“ছয়টি।”
-“তো এবার যোগ করে বলুন, আমার দুই হাতে কয়টি আঙুল হলো?”
লোকটা যোগ করে বলল,
-“এগারোটা.. এহ কেমনে, না না, দুই হাতে তো দশটা আঙুল।”
বুড়ো লোকটা কনফিউজড হয়ে যায়, বারবার গুনতে থাকে। ওদিকে ফাঁক পেয়ে পিহু, রিক, সুমনা ঢুকে পড়ে। বেশ কয়েকটা আম ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। তবে ঝামেলা বাধায় রিক। লাঠি দিয়ে আম পাড়ছিলো তারা, সে পণ্ডিতি করে ইটের টুকরো দিয়ে মারে ইটা। তবে তা গিয়ে ডিরেক্ট সেই ঘরের টিনের উপরে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে এক মহিলার চিৎকার ভেসে আসে,
-“এই কেডারে..”
-“শা*লার ঘরে শা*লা, তোরে কে বলছে উস্তাদি করতে।”
-“আরে, মানে”
-“এসব বাদ, আগে আম দ্রুত ব্যাগে রাখ, দেখে ফেললে কেলেংকারি।”
মহিলাটি আসতে আসতে তারা কিছু আম ব্যাগে রাখলেও, বাকি আম হাতেই রয়ে যায়। তাদের আম চুরি করতে দেখে রেগে যায় মহিলাটি, লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে,
-“কত্তো বড় সাহস, আমার বাগানের আম চুরি করস, দাড়া দাড়া। এই তোরা ঢুকলি কেমনে, আমার জামাই না পাহারা দিচ্ছিল।”
পিহুরা দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
-“এসব পরে দাদি, আগে সামনে দেখেন, আপনার জামাই জোয়ান মাইয়ার সঙ্গে টাংকি মারে। পিটানোর হলে জামাইকে পিটিয়ে সোজা করুন। নয়তো এ বয়সে জামাই হারাবেন।”
পিহুর কথায় মহিলাটি দাঁড়িয়ে গেটের দিকে তাকায়। আসলেই সুন্দরি এক জোয়ান মেয়ের সঙ্গে কি যেন আলাপ করছে তার বুড়ো জামাই। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আগুন ধরে যায়,
-“তবে রেএএএ, বউ রেখে অন্য বেডির সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি।”
এদিকে পিহুরা দৌড়াতে দৌড়াতে মেঘকেও টেনে নিয়ে যায় সাথে। দৌড়াতে দৌড়াতে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে মাঠে বসে পড়ে সব। সবাই হাপাচ্ছে, একে অপরের দিকে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে।
-“বুঝলাম না, আবেগের বয়স কি শেষ হয়ে গেছে নাকি, সব কিছুতেই বিবেক কাজ করছে।”
রিকের কথায় সুমনা ওর পিঠে চাপড় মেরে বলল,
-“তোর বিবেক আর গাধার বিবেক সেইম…”
রিক নাক তুলে বলল,
-“ঢং না ভাই, একে তো বেডার আম চুরি করলাম, তার চেয়েও বড় কথা, বেডার বউয়ের সঙ্গে যে ঝামেলা লাগাই দিলাম। এখন তো মনে কুচুমুচু করছে। যেই দজ্জাল বেডি, বেডারে যদি মারে…”
পিহু পাশ থেকে কাঁচা আম খেতে খেতে বলল,
-“বেডায় কেনো বেডিগোর কথা শুনতে গেলো? লুচ্চা বেডা, বউ থাকতে মেয়েদের কথায় কান দিলো কেন। ভালো হয়েছে, খাক বউয়ের থেতানি।”
মেঘ ব্রু কুচকে এদের কাহিনী দেখছে। ফুস করে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-“কোনদিন যে তোদের জন্য আমি হুদাই বাশ খাই। ভাই, তোরা কি ছোট বাচ্চা এখনো? এসব স্বভাব কখন ছাড়বি?”
-“তুমি মহিলা বিয়াইত্তা, তবে আমরা সিঙ্গেল, আমাদেরই সময়।”
হঠাৎ ফারহানের কথা মাথায় আসায়, মেঘ পিহুকে জিজ্ঞেস করল,
-“এসব বাদ, আগে বল ফারহান ভাইয়ের সঙ্গে ফের কি হয়েছে? কল ধরিস না কেন?”
পিহু মুখ মুচড়ে বলল,
-“ওই বেডার কথা বাদ দে, ব্রেকআপ করে ফেলবো। নিরামিষ বেডা।”
-“বেচারা আমাকে মেসেজ দিয়ে তোর খুঁজ নিচ্ছে, এমন বাচ্চামি করিস না, কথা বলে নে।”
-“এহ, আসছে কথা, আমার কথা শুনে? আমি তো শুধু একটা গানই শুনতে চেয়েছিলাম। বলে, তার গলার স্বর ভালোনা। আমি তাও বলেছি, শুনুন, আমি হিরো আলমের গানও নির্দ্বিধায় শুনতে পারি। আপনি গেয়ে যান, সমস্যা নেই। বেয়াদব বেডা, গাইল না, উল্টো ঘুমিয়ে গেল। এমব, আনরোমান্টিক জাওড়া বেডার সঙ্গে আর কথা বলবো না।”
পিহু কথাটুকু বলে সামনে তাকাতেই দেখে মেঘরা হাসছে। তার ব্রু কুচকে যায়, হাসির কি আছে, সে কি জোকস বলেছে?
-“আজব, হাসছিস কেনো তোরা, আমি কি জোকস বলেছি?”
-“তোমাকে দেখে হাসছে, তুমি তো আর জোকারের থেকে কম না।”
হঠাৎ ফারহানের গলায় পিহু চমকে উঠে, পেছনে তাকায়। ফারহান ফরমাল গেটাপে দাঁড়িয়ে। কিছুটা ভড়কে জিজ্ঞেস করল,
-“আ..আপনি এখানে কি করছেন?”
ফারহান পাত্তা না দিয়ে মেঘের উদ্দেশ্যে বলল,
-“ভাবি, এই বেয়াদবকে নিয়ে যাচ্ছি, চলে আসবেন আপনারা।”
বলেই পিহুর হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। পিহু হাত ছাড়াতে বিলাপ শুরু করে,
-“ছাড়েন, আমি কোথাও যাবোনা আপনার সঙ্গে। এই মেঘ, দেখ, তোর ননদকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে, কিছু বল আটকা।”
মেঘরা হাসছে তার কান্ডে, কিছুই বলছে না। তা দেখে পিহু ফারহানের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে ফের বলল,
-“ছেড়ে দে, শয়তান। আপনি আমার দেহ পাবেন, মন পাবেন না।”
ফারহান এবার ধমকে উঠল,
-“চুপ, বাদরামি অফ করো, নয়তো আর একটা কথা বললে কোলে তুলে নিবো, বেয়াদব।”
পিহুকে নিয়ে রওনা দেয় এক রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। পৌঁছেই গাড়ি থামিয়ে ফারহান পিহুর দিকে ফিরে। পিহু প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে তার দিকে। ফারহান হুট করে পিহুর চুলের পেছনে হাত দিয়ে এক টানে তাকে সামনে নিয়ে আসে,
-“তুমি কি আমাকে জ্বালিয়ে মারতে চাচ্ছো, পিহু?”
-“তোহ, আপনি আমার কথা শুনেন না কেনো? ভাইয়া ঠিকি বলে, আপনি একটা রসকষহীন মানুষ।”
ফারহান ব্রু কুচকে বলল,
-“বাচ্চামিতে স্বায় না দিলে রসকষহীন হয়ে যায় মানুষ?”
-“মুটেও ওগুলো বাচ্চামি না।”
হঠাৎ ফারহান মুখটা একদম পিহুর মুখ বরাবর নিয়ে আসে হিসহিসিয়ে বলল,
-“রসকষ কেমন আছে আমার ভেতরে, একটু দেখাই?”
পিহু হকচকিয়ে ওঠে। কি বলে এই ছেলে, সে কিসের কথা বলছে?
-“আ…আপনি কিসের কথা বলছেন?”
ফারহান মুখটা আরও সামনে এগিয়ে আনে, তাদের মধ্যে এক ইঞ্চি ব্যবধান। হঠাৎ ফারহানকে এত কাছাকাছি দেখে পিহুর প্রান পাখি যেনো উড়ে যায় যায়। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে, চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না বেচারি। পিহুর এ অবস্থা দেখে ফারহান মিটি মিটি হাসছে। পিহু আসফাস করছে, ছাড়া পেতে চায়। একপর্যায়ে ফারহান তাকে ছেড়ে শব্দ করে হেসে উঠে,
-“এতোটুকুতেই শেষ রসকষ দেখাতে লাগলে তো একদম নাই হয়ে যাবে।”
ফারহানকে মজা উড়াতে দেখে পিহু কড়া চোখে তাকায়। তাকে ভয় দেখাতেই যে এমনটা করেছে, বেশ বুঝতে পারছে। তবে পিহু কি ভয় পাওয়ার লোক নাকি? মোটেও না। নিজেকে সামলে বুক ফুলিয়ে বলে,
-“হাহ, আমাকে কি মনে করেন ভয় পেয়েছি? মুটেও না, আমাকে উপরে দেখতে ভালোমানুষ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে আমিও ইমরান হাশমি।”
ফারহান সিটবেল্ট খুলে বড়োতে নিচ্ছিলো, হঠাৎ পিহুর কথায় মুহূর্তে তার শুকনো কাশি উঠে যায়, কাশতে কাশতে চোখ বড়বড় করে তাকায় তার দিকে। ফারহানের দৃষ্টি পেয়ে পিহুর হুশ ফিরে, সে কি বলতে কি বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে মুখে হাত চলে যায়। মনে মনে দু’বার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে ফেলেছে।
-“কি বললে তুমি?”
-“ক..কই কি?”
-“বুঝেছি, বিয়েটা জলদি করতে হবে।”
বলতে বলতেই তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে। ঢুকতেই পিহু চারিদিকে দেখতে থাকে। পুরো রেস্টুরেন্ট খালি, তবে সুন্দর করে সাজানো, আশেপাশে বেলুন, ফুল দিয়ে ডেকোরেশন করা। পিহু দেখতে দেখতে বলে,
-“এই, এটায় কারো জন্মদিন হয়তো, চলুন আমরা অন্যটায় যাই।”
বলতে বলতেই পাশে ফিরে তাকাতেই দেখে ফারহান নেই। চকিত নজরে আশেপাশ খুঁজতে থাকে। কোথায় গেলো ফারহান এই শুনশান রেস্টুরেন্টে তাকে একা রেখে? ভয়ে ভয়ে পেছন ঘুরে বের হয়ে আসতে নেয়। ঠিক তখনি আশেপাশের সব লাইট জ্বলে উঠে, সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে গোলাপের পাপড়ি এসে পড়ে পিহুর উপর। পিহু অবাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। তখনই পেছন থেকে একটি গলা ভেসে আসে,
-“ওহে আমার প্রিয় অবাধ্যনারী, আজকের মতো একটু বাধ্য হয়ে, আমার কথায় একটু পেছন ফিরে দেখুন।”
পিহু সাথে সাথে পেছন ফিরে তাকায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরিচিত মুখগুলো। ফারহান হাটু মুড়ে বসে আছে। তার হাতে রিং বক্স, পিছে ফারহানের পরিবারসহ পিহুর পরিবার। পিহু অবাক, তার ভাই, বাবা, চাচা সব এখানে।
-“আপনাকে আমি হালালভাবে আমার ঘরে তুলতে চাই। আপনার বাদরামি, বাচ্চামি, আপনার সাথে যুক্ত যত যা আছে সবকিছুকে আমি নিজের করে গ্রহণ করতে চাই। আপনাকে আমি আমার জীবনের প্রথম ও শেষ নারী হিসেবে আমার ঘরে তুলতে চাই।”
ফারহানের কথায় পিহু কী রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না। চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছে, হাত কাপছে। এতোগুলো মানুষের সামনে ফারহান এভাবে তাকে চাইতে পারে, কল্পনার বাইরে। ভীষন অবাক, বিষ্ময় সব মিলিয়ে কেমন এক অনুভূতি। তাকে চুপ থাকতে দেখে ফারহান নরম গলায়, আকুতিভরা সুরে ফের বলল,
-“আপনি কি আমার এই চাওয়াগুলো পূরণ করতে রাজি? আমার জীবনসঙ্গী হতে রাজি? মিসেস ফারহান রাশেদ ভূঁইয়া হতে রাজি?”
পিহু ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে, আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বাধ ভেঙে। একবার পেছনে বাবা-মা-ভাইয়ের দিকে তাকাতে দেখে তাদের মুখেও হাসি। তারা মেয়ের তাকানো দেখে বুঝে নেয়, মেয়ে তাদের ইচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করছে। চোখ দিয়ে আশ্বাস দেয় তারা। পিহু একবার মেঘদের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসে, হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে পরপর কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে বলল,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আপনার সারাজীবনের সঙ্গী হতে চাই।”
ফারহানের মুখেও হাসি ফুটে উঠেছে, চোখে পানি চিকচিক করছে। আলতো হাতে পিহুর নরম হাত ধরে, অনামিকা আঙুলে রিং পরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে আবারও গোলাপের পাপড়ি পড়তে থাকে, সাথে সবার হাততালির শব্দ। রুদ্র এগিয়ে এসে পকেট থেকে রিং বক্স বের করে পিহুর হাতে দেয়। পিহুও কাপাকাপা হাতে ফারহানকে রিংটা পরিয়ে দেয়।
সেদিন চৌধুরি পরিবার ও ভূঁইয়া পরিবার মেতে উঠে উৎসব আনন্দে। ছেলে-মেয়ের বিয়ে বলে কথা। চৌধুরি বাড়ির খুশি রাখে কই, একসাথে দুই মেয়ের বিয়ে। সামিয়া রাফানের বিয়ের কথা চলছিল, এর মাঝেই ফারহানের হঠাৎ ডিসিশনে সবাই মিলে সেদিন সিদ্ধান্ত নেয় একই ডেটে বিয়ে দেবার। বাড়ির কর্তারা একসাথে দুই মেয়ের বিদায় দিতে রাজি না হলেও, ফারহান নিজের প্রেয়সিকে তাড়াতাড়ি নিজের করে পেতে বহু কষ্টে পরিবার রাজি করিয়েছিল।
সেদিন সবাই খুব খুশি ছিল। সুযোগ বুঝে সাদও ধাপ মেরেছিল, নিজের ভালোবাসাকে মা-বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে। সুমনাকে এনামুল চৌধুরী নিজের মেয়ে হিসেবেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।
ফারহানের ডাকে কল্পনা থেকে বের হয় পিহু। পিহুর মুচকি মুচকি হাসি দেখে ফারহান ব্রু কুচকে চেয়ে বলল,
-“কি ব্যাপার, হাসছো কেনো?”
ফারহানের গাল টেনে বলল,
-“ও, কিছুনা, আগের কথা মনে পড়েছিল।”
হঠাৎ ফারহান প্রশ্ন করে উঠল,
-“আমি যে তোমাকে কতবার ফিরিয়ে দিতাম, তারপরও কেনো আমার কাছেই ঘুরেফিরে আসতে? তোমার কি একটুও রাগ হতোনা আমার উপর?”
পিহু হেসে উত্তর দিল,
-“নারী হয় যত্নের পাগল, যেখানে যত্ন পায় সেখানেই থাকে। আপনি মুখে যাই বলতেন, আপনার কাজকর্মে যত্নের ছোঁয়া পেতাম। তাই রাগ-অভিমান হলেও ছেড়ে যেতে পারিনি।”
ফারহান নির্বাক চোখে চেয়ে, একটা মেয়ে তাকে এতোটা ভালোবাসে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে,
-“আমার প্রতি কোনো রাগ আছে তোমার?”
পিহু মাথা তুলে তাকায়,
-“আপনার নামে যখন প্রথম কবুল বলেছিলাম, তখনি আপনার প্রতি সব অভিমান খসে পড়েছিল। দ্বিতীয় কবুলে সব রাগও ঝরে পড়েছিল। আর তৃতীয় কবুলে আপনার প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আরও হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।”
ফারহান তার কপালে গভীরভাবে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে বলল,
-“ভালোবাসি জান, অনেক অনেক ভালোবাসি।”
-“আমিও আপনাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি।”
সেদিন রাতে পিহু আরও দুই-তিন বার বমি করেছিল। সকালে এরশাদুল চৌধুরী ফোন করে দাওয়াত দিতে, মেয়ের অসুস্থতার খবর শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েন। ফারহান আশ্বাস দেয়, একটু পর ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে যাবে। তারপর পিহুকে নিয়ে নাস্তা করে বের হয় মেডিকেলের উদ্দেশ্যে।
–––
-“আব্বু, এই যে এই বক্সে আপনার প্রতি বেলার ওষুধ আলাদা আলাদা করে রাখা আছে, আমি কিন্তু এসে চেক করব কয় বেলা খেয়েছেন। আর মা, আপনার প্রেশারের পাতা প্রথম ড্রয়ারে রেখেছি। যদি শরীর খারাপ লাগে সবার আগে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাবেন।”
সামিয়া সেই কখন থেকে শ্বশুর-শাশুড়িকে বুঝিয়েই যাচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে সে কয়েক বছরের জন্য বাপের বাড়ি যাচ্ছে বাচ্চাকাচ্চা রেখে। ফারুখ তালুকদার হেসে বলল,
-“দু’টো দিনের জন্যই তো যাচ্ছিস মা, এত টেনশন করতে হবে না। এই বুড়ো-বুড়ি বিন্দাস থাকতে পারবে।”
সামিয়া সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে বলে,
-“সামনে থেকেই বারবার বলে খাওয়াতে হয় ঔষধ, না থাকলে তো ওষুধ কি জিনিস মনেই থাকবে না আপনাদের। আছিয়া খালা, আপনি কিন্তু রান্না শেষে রান্নাঘর সুন্দর করে গুছিয়ে তারপর যাবেন। নোংরা যেন না থাকে।”
-“আইচ্ছা মা, চিন্তা কইরোনা। তুমি কেমনে কাজ করতা দেখছি তো, ওমনেই গুছাই রাখমু। তুমি যাও যাও রেডি হও গিয়া। রাফান বাপ আইলেই তো যাইতে হইবো।”
সামিয়া আর কথা না বাড়িয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে তৈরি হতে। একটু পরই বেরোবে চৌধুরি বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাবতেই মনটা খুশি হয়ে যাচ্ছে।
তালুকদার কর্তা-কর্তী বসে আছেন। মুখে তাদের খুশির ঝলক, মেয়েটা সংসারটাকে একদম নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। সবকিছু সামলে রাখে।
-“আমাদের ছেলে বেছে বেছে হিরের টুকরোই এনেছে গো। আল্লাহ যেন তাদের ভবিষ্যতে আরও সুখে রাখে।”
রাফান কেবলই বাসায় ফিরেছে। রুমে ঢুকতেই তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হতে দেখে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সামিয়া আয়নায় রাফানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে। তার হাসি দেখে রাফান চোখ-মুখ খিঁচে বলে ওঠে,
-“উফফফ এখানেই তো মরে যাই।”
তার কথায় সামিয়া খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তাকে ছাড়িয়ে বলে,
-“হয়েছে, আগে ফ্রেশ হয়ে আসুন, ওই যে কাপড় রাখা আছে বিছানায়।”
মাথা নেড়ে চলে যায় বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই দেখে সামিয়া শাড়ির আঁচলে ঘাড়ের দিকটায় পিন মারতে চেষ্টা করছে। তা দেখে সে এগিয়ে গিয়ে তার হাত থামিয়ে দেয়। পিন নিজের হাতে নিয়ে সুন্দর করে পিনটা লাগিয়ে দেয়। তারপর ঘাড়ে পড়ে থাকা চুলগুলো এক হাতে সরিয়ে সেখানে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া একে দেয়। সামিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে নেয়। তা দেখে তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দু’গাল নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কপালেও একবার নিজের ঠোঁট চালায় রাফান,
-“তুমি এত আদুরে কেনো বউ?”
সামিয়া চোখ মেলে তাকাতে নিলে তার চোখের উপর আবারও ঠোঁট ছোঁয়ায়। আলতো করে বুকে জড়িয়ে নেয়। সামিয়ার চোখের কোনায় পানি,
-“আমাকে এত ভালোবাসেন কেনো?”
-“কারণ তুমি আমার আদুরে পাখি, আমার একান্ত সুখ।”
সামিয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাফানকে, মনে মনে কয়েকশবার আলহামদুলিল্লাহ বলে নেয়। প্রতিক্ষণেই সে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। সে বিশ্বাস করত আল্লাহ তার বান্দার জন্য উত্তম পরিকল্পনা করে রাখে, আর সেই বিশ্বাস তার দিনকে দিন আরও গভীর করছে। একজন নারীর সুন্দর একটা সংসার আর স্বামীর ভালোবাসা ছাড়া আর কি-বা চাওয়ার আছে? এগুলো যারা পায় তারাই পৃথিবীর সুখী মানুষ।
চলবে…
[প্রিয় পাঠকবৃন্দ,
আপনাদের অফুরন্ত ভালোবাসা আর প্রিয় জুটিগুলোকে মিস করার আবেগই আমাকে আবারও তাদের নিয়ে লেখতে বাধ্য করেছে। রুদ্র-মেঘ, ফারহান-পিহু সহ সবার জন্যই আপনাদের আগ্রহ আর প্রত্যাশা দেখে আর না লিখে থাকতে পারিনি। অনেকেই অভিযোগ করেছিলেন, শেষটায় যেন পুরোপুরি তৃপ্তি পাননি। বিশেষ করে ফারহান-পিহুকে নিয়ে আরও কিছু চেয়েছিলেন আপনারা। তাই আপনাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতেই এবার ফারহান-পিহুকে নিয়ে একটু বেশি লেখার চেষ্টা করেছি। আর হ্যাঁ, আগামীকালও আসছে সর্বশেষ একটি পর্ব, অবশ্যই পড়বেন।]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪৫
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩৬
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫০
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৮
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৩১
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ২৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ১২
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪২
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫১