#আড়ালে_তুমি |৫৭|
#_সাইদা_মুন
ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই আশেপাশে ভীড় জমে যায়। রুদ্র হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে নিচে পড়ে থাকা রাহুলের দিকে। এখন তার কী করা উচিত, মুহূর্তের জন্য যেনো ভুলেই গেছে। চোখের সামনে প্রাণপ্রিয় বন্ধু রক্তে ভেসে যাচ্ছে, অথচ সে যেনো জমে গেছে। চারপাশে মানুষজন কেউ ভিডিও করছে, কেউ হৈচৈ করছে, যেনো কোনো সিনেমার দৃশ্য চলছে।
এরই মাঝে সায়ানরা ভীতু মনে দৌড়ে আসে ভীড় ঠেলে। মেঘেরর জায়গায় রাহুলকে দেখে সবাই হতচকিত। সারা হঠাৎ চিৎকার করে উঠে,
-“রাহুললল”
সবাই এগিয়ে আসে ফারহান হন্তদন্ত হয়ে চিৎকার করে উঠলো,
-“সার্কাস দেখছিস একেকটা কু****। জায়গা ফাঁকা কর! এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।”
ফারহানের গলার শব্দে যেনো রুদ্রের হুঁশ ফিরে। মুহূর্তেই পাগলের মতো দৌড়ে গিয়ে রক্তে ভেজা রাহুলকে ফারহান থেকে ছিনিয়ে কাঁধে তুলে নেয়। তাকে গাড়িতে উঠিয়ে দ্রুত ছুটে যায় হাসপাতালে।
হাসিখুশি এই সফরে হঠাৎ এমন ঘটনা, সবাই ভেঙে পড়েছে, চোখ ভিজে যাচ্ছে একেকজনের। এদিকে মেঘকে ধাক্কা মেরে সাইডে সরিয়ে দিকেও সে নিজেকে সামলে উঠতে না পেরে রাস্তার পাশের পিলারে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। হাত-পায়ে চোটও লেগেছে। পিহু, সুমনা আর সামিয়া দৌড়ে গিয়ে তাকে তুলে। তারাও মেঘকে গাড়িতে তোলে, পানি ছিটিয়েও মেঘ জ্ঞান ফিরছে না। পিহু আর সুমনা কান্না করছে খুব। সামিয়া কাঁপতে থাকা গলায় দু’জনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কাছের হাসপাতালে পৌঁছাতেই সবাই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকে। রুদ্র ভেতরে ঢুকেই চিৎকার করে ওঠে,
-“ডাক্তাররর, ডাক্তার!”
তার চিৎকার আর রাহুলের রক্তাক্ত শরীর দেখে সবাই দ্রুত এগিয়ে আসে। ডাক্তার কাছে এসে তাকিয়েই বলে উঠে,
-“ইমিডিয়েটলি অপারেশন থিয়েটারে নিন। অবস্থা খুবই ক্রিটিকাল। আর আপনারা রিসিপশনে গিয়ে ফরম পূরণ করুন, ফাস্ট!”
বলেই ডাক্তার রাহুলকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে, আরও কয়েকজন ডাক্তার ছুটে যায় তার সাথে। সায়ান ফরম ফিল আপ করলো, রাহুলের পরিবারকেও খবর দিয়েছে ইতোমধ্যে। তারা রওনা হয়ে গেছে সঙ্গে সঙ্গেই।
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে রুদ্ররা বসে আছে। সারা বন্ধুর এই অবস্থায় কাদঁতে কাঁদতে ভেঙে পড়েছে, অন্যদের চোখেও অশ্রু। রুদ্র মাথা নিচু করে নিশ্চুপ বসে আছে। শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু ভেতরে তোলপাড় চলছে। হঠাৎ মাথা তুলে প্রশ্ন করলো,
-“কীভাবে হলো?”
সায়ান ভাঙা গলায় উত্তর দেয়,
-“মেঘকে বাঁচাতে গিয়ে… সে নিজেই…”
সেখানেই গলা ধরে আসলো তার আর বকতে পারেনা। রুদ্র হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। চারপাশে তাকিয়ে কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলে
-“ম..মেঘ কোথায়? ঠিক আছে তো? কই ও? দেখছি না কেনো? ওকে ফেলে আসি নিতো? শিট আমি এতোটা কেয়ারলেস হলাম কি করে। আমার মেঘ.. “
পাগলের মতো প্রশ্ন করতে করতে পিহুকে কল দেয়। সবাইও চুপসে যায় কারণ কেউই মেঘের খোঁজ জানেনা, রাহুলের দিকেই ব্যস্ত ছিলো সবাই। পিহু কল রিসিভ করতেই জানতে পারলো, মেঘ সেন্সলেস এই হাসপাতালেই আছে। কথাটা শুনতেই যেনো বুকটা হিম হয়ে এলো রুদ্রের। আর কিছু না ভেবে ছুট লাগায় মেঘের কেবিনের দিকে। রক্তমাখা শার্ট, এলোমেলো চুল, পাগলের মতো ছুটে চলা ছেলেকে দেখে চারপাশের মানুষ তাকিয়ে নানা উপাধি দিচ্ছিলো। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই।
মেঘের কেবিনের সামনে এসেই হঠাৎ পা থেমে গেলো। ডাক্তারকে বের হতে দেখে, সাথে পিহু। ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ডাক্তার, ঠিক আছে তো ও? আমার মেঘের কিছু হয়নি তো?”
ডাক্তার একবার পিহুর দিকে তাকাতেই, পিহু আস্তে বললো,
-“পেশেন্টের হাজব্যান্ড।”
ডাক্তার মুচকি হেসে উত্তর দিলো,
-“চিন্তার কিছু নেই। মাথায় আঘাত আর ট্রমা থেকেই অজ্ঞান হয়েছিলো। ইঞ্জেকশন দিয়েছি, ১/২ ঘন্টার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে। শরীরে কয়েক জায়গায় চোট ছিলো, নার্স ড্রেসিং করে দিয়েছে।”
ডাক্তার চলে যেতেই রুদ্র কেবিনে ঢুকে। মেঘ শান্তভাবে শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ নড়াচড়া নেই। সুমনা রুদ্রকে দেখে চুপচাপ বেরিয়ে গিয়ে পিহুর সাথে বাইরে দাঁড়ায়।
রুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে বসে। মেঘের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে বুকের কাছে চেপে ধরে গভীর এক নিশ্বাস ফেললো। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নেড়ে দোয়া পড়ে বেশ কিছুক্ষন, তারপর আস্তে করে ফুঁ দিয়ে দেয় মেঘের শরীরে। নিঃশব্দে কপাল থেকে ধরে সারা মুখে চুমু দিয়ে ভড়িয়ে দেয়। দু’বাহু ধরে বুকে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমন্ত মেঘকেই। মনে হচ্ছিলো বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিলেই শান্তি পাবে। সেভাবেই জড়িয়ে ধরে বসে থাকে, ভেতরে ভেতরে যেনো অজানা ভয়ে কেপে উঠছে বার বার। এভাবেই সময় যায় প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পার হয়ে যায়। হঠাৎ কল আসায় রিসিভ করতে সায়ান বলে ইমারজেন্সি রক্ত লাগবে যেতে। এক মুহূর্ত দেরি না করেই রুদ্র উঠে দাঁড়ালো। মেঘকে পিহু আর সুমোনার কাছে রেখে সে ছুটে যায় রক্ত দিতে।
অপারেশন রুমের করিডোরে পৌঁছাতেই চোখে পড়ে, রাহুলের বাবা-মা ভেঙে পড়া অবস্থায় বসে আছেন। মা কপালে হাত দিয়ে বারবার ফিসফিস করে দোয়া পড়ছেন। বাবা বার বার চোখ মুছছেন, সাথে স্ত্রীকেও সামলাচ্ছেন। আশেপাশে আত্মীয়-স্বজন দাঁড়িয়ে কাঁদছে। রাহুলের হবু বউ সাফার দিকে চোখ যেতেই দেখে, মেয়েটিকে একজন ধরে বসে রেখেছে। কান্না করতে করতে হয়তো নিস্তেজ হয়ে গেছে। একটা হাসি-খুশি পরিবার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
রুদ্র আর না দাঁড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গেই চলে যায় ব্লাড ডোনেশন রুমে। সেখানে সায়ান আর ফারহানও উপস্থিত, ওরাও রক্ত দেবে। সবার মনে একটাই দোয়া “বন্ধুটা যেন আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।”
রক্ত নেওয়া হতেই একজন নার্স দ্রুত তা নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে যায়। দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বাইরে সবাই অপেক্ষায়। গুমোট বাতাস, নিঃশব্দ কান্না।এর মধ্যেও রাহুলের মা বুক ফাটা আর্তনাদে কেঁদে উঠছেন বারবার। বার বার একই মিনতি করছে,
-“আমার ছেলেটাকে বাঁচান আল্লাহ। আমি কিছু চাই না, শুধু ও বেঁচে যাক। দরকার হলে আমার প্রাণটা নিয়ে নেন আল্লাহ, তাও আমার ছেলেটা, আমার বুকের মানিক, আমার জান বাচ্চাটাকে ফিরিয়ে দেন। আমার একমাত্র ছেলে, আমি কী নিয়ে বাঁচবো গো আল্লাহ? আপনি আমার বুক খালি করবেন না।”
উনার কথায় উপস্থিত সবার চোখ ভিজে যায়। রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, দ্রুত সরে গেলো অন্য পাশে। সাফা এসে উনার হাত ধরলো। গলা আটকে গেছে, কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-“আন্টি, ও ঠিক হয়ে যাবে। আপনি একদম কাঁদবেন না। ওর কিছুই হবে না।”
———
রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধারে। চোখ টলমল করছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে রাহুলের সাথে কাটানো অসংখ্য মুহূর্ত, ক্যান্টিনে আড্ডা, ক্লাস ফাঁকি, একসাথে ম্যাচ দেখা, হুট করে রাস্তায় চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে গল্প, বাইকে চড়া, মারামারি, হাসি-ঠাট্টা।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ রুদ্রর কাঁধে হাত রাখলো। সে তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নেয়। পেছনে ফিরতেই দেখে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। কিছু না বলে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে। ফারহান হাত একটু বাড়াতেউ হঠাৎ রুদ্র ফারহানকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে। ফারহানও কাঁদছে। রাহুলের এই দশা কেউই মানতে পারছে না। রুদ্র আতংকিত গলায় বলে,
-“রাহুল ঠিক হয়ে যাবে তাই না রে? ওকে ঠিক হতে হবে, হতে হবে। ওকে ছাড়া আমি চলবো কি করে?”
ফারহান কণ্ঠে ভরসা দিয়ে বলে,
-“কিছু হবেনা। নিজেকে সামলা। আমরা ভেঙে পড়লে রাহুলের পরিবারকে কে সামলাবে?”
পুরুষের বোধহয় কাঁদতে নেই নিয়ম, কিন্তু আজ তারা দু’জনই নিয়ম ভেঙে কাঁদছে। রুদ্র যেনো তার কষ্ট ভাগ করার জায়গা পেয়েছে। মুখে কোনো শব্দ নেই, তবে দুজনের চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। এদিকে দূর থেকে সবকিছু দেখছে শান্ত আর সায়ান। তাদের চোখেও জল। শান্ত হালকা গলায় বলে উঠে,
-“আজ কতো বছর পর এরা এক হলো? রাহুল যদি এই দৃশ্যটা দেখতো, কতো খুশি হতো তাই না। ও তো কত চেষ্টা করেছিল রুদ্র-ফারহানের সম্পর্কটা আগের মতো করার, তবে পারে..”
সায়ান ধরা গলায় বলে,
-“পেরেছে, সে এক করতে পেরেছে। তবে সে নিজেই দেখার অবস্থায় নেই…”
শান্ত সায়ানকে জড়িয়ে ধরে,
-“আমাদের গ্যাংটা আবার আগের মতো হবে তাই না রে? রাহুল ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাবো।”
তাদের চোখ দিয়েও নীরবে জল গড়িয়ে পড়ছে। আসলেই বন্ধুত্বের আসল মানে তখনই বোঝা যায়, যখন মৃত্যু এসে দাঁড়ায় দরজায়। বন্ধু অসুস্থ হলে শুধু ওর শরীরটাই নয়, পুরো বন্ধুমহল শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায়। একসাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘোরা। ক্যান্টিনে একই প্লেট ভাগাভাগি করে খাওয়া। কাউকে কষ্ট দিলে সেটা মিলে বসে গোপনে সমাধান করা। ছোট্ট আনন্দ থেকে বড় দুঃখ সব ভাগাভাগি করা।
আজ সেই বন্ধু হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। সে শুধু একা নয়, সে সাথে তার প্রতিটা বন্ধুও নিজেদের বন্ধু হারানোর ভয়ের সাথে লড়াই করছে।
———
টানা ২ ঘন্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসতেই সবাই ছুটে গেলো সামনে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, কেমন আছে, কি অবস্থা? রুদ্র ফারহান ও এগিয়ে আসে। ডাক্তার শক্ত গলায় বলেন,
-“আমার সাথে আসুন স্যার।”
রুদ্ররা বাকিদের বুঝিয়ে ডাক্তারের পিছু নিলো। কেবিনে বসে ডাক্তার বলেন,
-“আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা যা করার করেছি, বাকিটা আল্লাহর হাতে। পরিবারের সবাইকে একে একে দেখা করার সুযোগ দিন। বাঁচার সম্ভাবনা ১০% ও নেই।”
কথা শুনে রুদ্র ফারহান দুজনেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, অনুভূতিশূন্য, ফাঁকা লাগছে মাথা।
ডাক্তার তাদের দিক বুঝে বলে আবার বলেন,
-“স্যার, নিজেদের সামলান। সবাইকে একবার একবার করে ভেতরে নিয়ে যান। রোগীর সাথে দেখা করান। যেকোনো সময় খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।”
রুদ্র মাথা নেড়ে রোবটের মতো বের হয়ে এলো। পাশে ফারহান তার কাধ ধরে দাড় করিয়ে দেয়। রুদ্র মাথা ঘুরে তার পানে তাকাতেই ফারহান বলে,
-“নিজেকে শক্ত রাখ, আমরা ভেঙে পড়লে তার মা বুঝে যাবে। এখন কিছু বলা যাবে না।”
রুদ্র কিছু না বলেই বাইরে আসে, রাহুলের মা ছুটে এলো তার কাছে,
-“ও রুদ্র বাবা, বল না ডাক্তার কী বলেছে? আমার বাবাটা ঠিক আছে? বিপদমুক্ত তো?”
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে মাথা নেড়ে ইশারা করলো সুস্থ আছে। রাহুলের মা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে উঠলেন, যেনো একটা বাচ্চাকে তার প্রিয় পুতুল কিনে দেয়া হয়েছে। রুদ্র হঠাৎ রাহুলের মাকে চেয়ারে বসিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার হাত ধরে বলে,
-“আমাকে তোমার আরেকটা ছেলে মনে করো তো মামনি?”
এরমধ্যেই মেঘকে নিয়ে পিহুরাও এসেছে। সে এখন সুস্যতাই এখানে আসতে চাইছিলো। তার জন্য আজ রাহুকের এই অবস্থা আর সে আসবে না। মেঘকে দেখে সারা চেয়ার এগিয়ে দিলো বসার জন্য। রাহুলের মা রুদ্রর মুখে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিলেন,
-“অবশ্যই তুইও আমার আরেকটা ছেলে।”
রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বলে,
-“তাহলে এই ছেলেকে দিয়েই বাকি জীবন চলবে তো?।”
উনি কথার মানে না বুঝে শুধু চেয়ে থাকলেন। রুদ্র ফট করে উঠে দাঁড়ায়,
-“ডাক্তার পারমিশন দিয়েছেন, সবাই একে একে রাহুলকে দেখে আসুন।”
রুদ্রের কথা শোনতেই, উনারা ছুটে গেলেন ভেতরে। রাহুলকে দেখে চোখে পানি সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, মাথায় পট্টি, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। মা কাঁদতে কাঁদতে ছেলের গালে হাত রাখলেন। রাহুল চোখ খুলে মুচকি হেসে কোনো মতে মাস্ক সরিয়ে উচ্চারণ করে,
-“আম্মু আম্মু”
মা সাথে সাথে ছেলের হাত চেপে ধরে,
-“বাবা, এইতো আম্মু আছি। এটা লাগিয়ে রাখো, তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।”
রাহুল কষ্ট করে বলে,
-“আম্মু, আমার জন্য কান্না করো না। তোমার চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারি না।”
মা চোখের জল মুছে বললেন,
-“না বাবা, আমি কাঁদছি না। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।”
রাহুল হালকা হেসে উঠলো। আবার হাল্কা গলায় বলে,
-“আ..ম্মু আমা..র কিছু হ..লে সাফাকে ত..তুমি নিজ দায়িত্বে ভালো ঘ..রে তু..লে দিয়ো..”
রাহুলের মা চমকে উঠে দ্রুত বলেন,
-“না আব্বু তোমার কিছু হবেনা। এসব কথা মুখে নেয়না। আল্লাহ তোমাকে দ্রুত আমার বুকে ফিরিয়ে দিবেন সুস্থ করে।”
মায়ের কথায় রাহুল হাসে সে জানে, আর সুস্থ হবার সম্ভাবনা নেই। এক এক করে সবাই ভেতরে গেলো, শেষে রুদ্র। তার চোখে জল নেই, কেমন কৃত্রিম হয়ে গেছে। রাহুল হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকে।
-“রু..দ্র এ কটা রিকোয়েস্ট রাখবি?”
রুদ্র দ্রুত হাত ধরে বলে,
-“তুই শুধু বল, আমি জান দিয়েও রাখবো।”
রাহুল হেসে অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
-” আমাকে ওয়াদা দে মে..ঘকে সবসময় প্রোটে…ক্ট করবি। আমি তোকে বলতে পারি…নি। ক..কিন্তু আ আজ বলতে চাই আমি মেঘকে ভালো…বাসি। ন..নিজের করে পেতে চেয়ে..। তার আ আগেই তুই বিয়ে করে ফেললি। সত্যি আমি মন থে..কে চেয়েছিলাম রে তা..কে। তবে পাইনি, কিন্তু আ আফসোস নে..ই তাকে তো নিজের জীবন দি.য়ে বাচাঁতে পারলাম। এবার তুই ওয়াদা কর.. যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে…”
বলতে বলতে তার শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়ে গেলো।রুদ্র হকচকিয়ে দ্রুত মাস্ক লাগিয়ে ডাক্তার ডাকলো। সবাই ভেতরে চলে আসে। কান্নার রোল পড়ে যায় চারিপাশে। রোগীর অবস্থা দেখে ডাক্তার সবাইকে বের করে দিলেন। সবার মনে আবার অন্ধকার নেমে এসেছে। রুদ্রর কানে শুধু বাজছে রাহুলের বলা কথাগুলো।
প্রায় ১০ মিনিট পর ডাক্তার বেরিয়ে আসে, সবাই আগ্রহ নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ডাক্তার মাথা নিচু করে বলেব,
-“সরি উনি আর নেই।”
সাথে সাথে সব নিস্তব্ধ। সবাই যেনো বড়সড় এক ঝাটকা খেয়েছে। রাহুলের মা আর সাফা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। রুদ্র দু’কদম পিছিয়ে গিয়ে দেয়াল ধরে দাঁড়ায় স্থির হয়ে রইলো। চোখ তার ফাঁকা। এক ধ্যানে তাকিয়ে রাহুলের কেবিনের দিকে। মেঘ দৌড়ে এসে তাকে আঁকড়ে ধরলো। চারপাশে শুধু কান্না, হাহাকার, আর্তনাদ।
রাহুল আর নেই।
———
রাহুল মারা যাওয়ার এক মাস হতে চললো। কিন্তু কারও জীবন তার জন্য থেমে নেই, সবাই নিজেদের ছন্দে চলছে। শুধু দিনের শেষে হঠাৎই তার কথা মনে পড়লে প্রিয়জনদের বুকের গভীর থেকে তীব্র এক ব্যথা অনুভব হয়। রুদ্ররা কেউ না কেউ প্রতিদিন একবার হলেও রাহুলের বাড়িতে যায়, তার মাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
ভার্সিটি এসেই মেঘ বাকিদের ক্লাসে যেতে বলে নিজে কোথাও যাওয়ার জন্য উঠে, পিহু আটকে দেয়,
-“কিরে, একা একা কোথায় যাবি? আমরাও যাবো…”
মেঘ একটু চিন্তিত স্বরে বলে,
-“না না প্লিজ, তোরা ক্লাস কর। আমি একটু দরকারে যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”
তাদের অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে অবশেষে বের হয় মেঘ। রিকশা নিয়ে রওনা হয় তার গন্তব্যে। কাজ শেষ করে যখন বেরোয়, তখন চিন্তায় ডুবে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। মনমরা হয়ে আনমনে কিছুদূর হেঁটেই হঠাৎ চোখে পড়ে রুদ্রের গাড়ির মতো দেখতে একটি গাড়ি। পরক্ষণেই ভাবে, দেশে কি শুধু একটাই এমন গাড়ি আছে নাকি? ভেবে আবার সামনে এগোয়। কিন্তু আরেকটু যেতেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়েকে দেখে আটকে যায়। এইটা তো সাফা চাবতে ভাবতেই। ভ্রু কুঁচকে থেমে যায় মেঘ।
এর কয়েক সেকেন্ড পরেই গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আসে রুদ্র। গিয়ে অপর পাশের দরজা খুলে দিতেই সাফা মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে। তারপর রুদ্র নিজেও উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। পুরো ঘটনাটা মেঘের কাছে একদমই স্বাভাবিক মনে হলো না। রুদ্র এই মেয়েকে নিয়ে এখানে কী করছিলো? ভাবতে ভাবতেই গাড়িটা চোখের আড়াল হয়ে যায়। আর মেঘ রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে, মাথায় শুধু রুদ্রের কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
———
রাত ১০টা, যথারীতি এই এক মাস ধরে চলা রুটিন অনুযায়ী পিহু আবার তার নতুন নাম্বার থেকে কল দেয় ফারহানকে, শুধু তার কণ্ঠটা শোনার লোভে। হ্যালো কে বলতেই কল কেটে দেয়। এই এক মাস ধরে ফারহানের কাছ থেকে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এখনো ফারহানকেই আঁকড়ে আছে। কাউকে একবার মন দিয়ে ফেললে কি এতো সহজে তা আবার ফেরত নেওয়া যায়। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বের হয় আক্ষেপভরা ফিসফিস,
-“আপনি যদি একটুখানি আমার হতেন ফারহান, দেখতেন ভালোবাসা কারে বলে।”
———
ওদিকে রুদ্র বাসায় ফিরেছে হলো ১০ মিনিট। মেঘ তার অপেক্ষাতেই ছিল। সে আসতেই কাপড় এগিয়ে দেয়। রুদ্র চুপচাপ ফ্রেশ হয়ে এসে সবার সঙ্গে খাবার খেয়ে নেয়। রাতে রুমে ঢুকতেই মেঘ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
-“দুপুরে কোথায় ছিলেন…?”
রুদ্র একটু চমকে তাকায় মেঘের দিকে, ভ্রু কুঁচকে বলে,
-“কেনো? অফিসেই তো ছিলাম। আর কোথায় থাকবো?”
-“আর কোথাও যাননি?”
রুদ্র নির্দ্বিধায় জবাব দেয়,
-“না, যাইনি।”
মেঘ তাকিয়ে থাকে রুদ্রের দিকে, কি সুন্দর করে মিথ্যা বললো। অথচ সে নিজের চোখেই সব দেখেছে। তবু কিছু না বলে চুপচাপ পাশে শুয়ে পড়ে।
———
এভাবেই কেটে যায় আরও কিছুদিন। রুদ্র বদলে গেছে। মেঘের সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না, দূরত্ব বজায় রাখছে সবসময়। মেঘ তা টের পাচ্ছে, তবে কিছু জিজ্ঞেস করলে রুদ্র হেয়ালি করে এড়িয়ে যায়।
আজ শুক্রবার সকাল থেকেই বাড়িতে হইচই। রুদ্র একটা পার্টি আয়োজন করেছে। অনেক অতিথি আসবে বলে বাড়ি সাজসজ্জায় ব্যস্ত সবাই। বিকেল হতেই পিহু, মেঘ আর সামিয়াকে সাজগোছের জন্য রুদ্র পার্লারে পাঠিয়ে দেয়। সাজতে সাজতেই সন্ধ্যা নেমে আসে তাদের।
-“এহহেরে, সবাই বকা দিবে! এত লেট হয়ে গেলো…”
পিহু ফিসফিস করে কথাটি বলতেই সামিয়া হেসে জবাব দেয়,
-“আগে দেখে হাঁট, গাধি। নয়তো পড়ে গিয়ে এতো সময়ের মেকাপ সব একেবারেই যাবে।”
তারা সবাই দ্রুত গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে। সব মেহমান চলে এসেছে মানুষে গমগমে পরিবেশ। তাড়াহুড়ো করে সামনের দিকে এগোচ্ছিল, কিন্তু কিছুদূর যেতেই রুদ্রের ঘোষণা শুনে মেঘের পা থমকে যায়। অবাক হয়ে তাকায় সামনে, রুদ্র একটি মেয়ের হাত ধরে পাশে দাড়ঁ করিয়ে বলে উঠে,
-“হ্যালো এভ্রিওয়ান, মিট মাই ফিয়ন্সে মিস….
চলবে…
[বাপরে বাপ, আগের পর্বে আমি সামান্য একটু বাতাস দিলাম আর তোমরা আমাকে ঘূর্ণিঝড় দিয়ে উড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা করতেছো। ভয়ে তো তোমাদের কমেন্টের রিপ্লায়ই দিলাম না। আজকে আবার না জানি কোন পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে ধাক্কা মারার চিন্তা করো আল্লাহ মালুম। হ্যাপি রিডিং।
]
Share On:
TAGS: আড়ালে তুমি, আড়ালে তুমি সাইদা মুন, সাইদা মুন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৬২
-
আড়ালে তুমি গল্পের লিংক সাইদা মুন
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৭
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫২
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৫২
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৪
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৪৩
-
আড়ালে তুমি পর্ব -৪১
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৩৩
-
আড়ালে তুমি সাইদা মুন পর্ব ৫৮