১৯৪৫ সালের সেই উন্মত্ত গ্রীষ্মে লস আলামোসের ল্যাবে তিনটে পারমাণবিক হৃৎপিণ্ড তৈরি হয়েছিল। প্রথমটা হিরোশিমাকে গ্রাস করেছিল। দ্বিতীয়টা নাগাসাকিকে মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় কোরটা, আমাদের কোর, ছিল যুদ্ধহীন এক অস্ত্র। প্রকল্পের অনাথ এক সন্তান। ওর কোনো নাম ছিল না।
শুরুতে ওর কোনো পোশাকি নাম ছিল না ঠিকই, কিন্তু আমরা জানতাম ওটা কী। ও ছিল খাঁচায় পোরা এক দানব। আর সেই দানব যে প্রথম রক্তের স্বাদ পেয়েছিল, সেই কাহিনীটাই হলো হ্যারি ড্যাগলিয়ানের।
ওর গল্পটা ছিল ল্যাবের এক অশুভ কিংবদন্তীর মতো, যা আমরা নতুন বিজ্ঞানীরা ক্যান্টিনে বসে একে অপরকে শোনাতাম। ড্যাগলিয়ান নাকি খুব শান্ত আর গোছানো মানুষ ছিলেন। যুদ্ধ থামার পর, ৪৫ সালের আগস্টের এক রাতে তিনি একা কাজ করছিলেন। সেই অভিশপ্ত কোর, যা তখনও সৃষ্টির উত্তাপে তপ্ত, ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। আমরা কল্পনা করতাম, নিঝুম ল্যাবে তিনি প্লুটোনিয়ামের গোলকটার চারপাশে টাংস্টেনের ভারী ইট দিয়ে একটা সর্বনাশা দুর্গ বানাচ্ছেন। আর কান পেতে শুনছেন গাইগার কাউন্টারের কিটকিট শব্দ, শুনছেন ড্রাগনটা কখন ঘুম ভেঙে নড়ে উঠবে।
সবাই বলত, একটা মুহূর্তের জন্য তার হাতটা কেঁপে গিয়েছিল। একটা মাত্র ইট, সামান্য একটা ভুল, আর সেটাই পড়েছিল ওই ব্যবস্থার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাগনের ঘুম ভেঙে গেল। যারা ছুটে ঘরে ঢুকেছিল, তারা দেখেছিল ড্যাগলিয়ান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর বাতাসে একটা অপার্থিব নীল আভা মিলিয়ে যাচ্ছে। সেই মুহূর্তেই তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। যদিও তার শরীরটা আরও পঁচিশটা দিন টিকে ছিল, আর রেডিয়েশন তাকে ভেতর থেকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছিল।
এরপর থেকে গোলকটা একঘরে হয়ে গেল। ওর গায়ে রক্তের দাগ লেগেছিল। কিন্তু লস আলামোসের সেই আশ্চর্য, নেশা ধরানো পরিবেশে, যেখানে আমরা নিজেদের বিধাতা ভাবতে শুরু করেছিলাম, ভয় কখন যে এক ভয়ঙ্কর অহংকারে বদলে গেল, আমরা টেরও পেলাম না।
আর লুই স্লোটিনের চেয়ে বেশি বেপরোয়া আর কেউ ছিল না।
স্লোটিন কোরটাকে দানব ভাবতেন না, ভাবতেন এক বুনো ঘোড়া, যার লাগাম শুধু তারই হাতে। তিনি মৃত্যুকে নিয়ে ছেলেখেলা করতেন। একটা সাধারণ স্ক্রুড্রাইভারের ডগা দিয়ে তিনি বেরিলিয়ামের দুটো বাটিকে আলাদা করে রাখতেন, আর কোরটাকে ঠেলে নিয়ে যেতেন ধ্বংসের দোরগোড়ায়।
২১শে মে, ১৯৪৬। ড্যাগলিয়ানের মৃত্যুর ঠিক নয় মাস পর, সেই খেলা চাক্ষুষ করার পালা ছিল আমার। ঘরে আমরা সাতজন। কোরটাকে ভেতরে আনতেই বাতাসটা যেন ভারী হয়ে উঠল। পালিশ করা গোলকটার দিকে তাকিয়ে আমার কেবল হ্যারি ড্যাগলিয়ানের কথা মনে পড়ছিল। তার জন্যও কি ল্যাবের বাতাসটা এমন গুমোট হয়ে উঠেছিল? কাউন্টারের শব্দটা কি এমনই উন্মাদ শোনচ্ছিল?
স্লোটিন সেদিন তার সেরা ফর্মে ছিলেন। এক ধরনের নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে চলেছিলেন, “ওরা যত কাছাকাছি আসবে, তত এর আঁচ টের পাবে।”
কথাটা মিথ্যে নয়। চামড়ায় যেন শুকনো গরম হলকা লাগছিল। কাউন্টারের কিটকিট শব্দটা পাগলের প্রলাপের মতো বাড়ছিল। আমি দম আটকে তাকিয়ে ছিলাম, আর আমার মন চিৎকার করে বলছিল একটাই নাম: ড্যাগলিয়ান।
আর ঠিক তখনই হাতটা ফসকে গেল।
একটা ভোঁতা ধাতব শব্দ, ক্ল্যাং। এতটাই মামুলি একটা শব্দ, যার ওই পারমাণবিক যজ্ঞে কোনও স্থান ছিল না।
আর তার অভিশপ্ত জীবনে দ্বিতীয়বারের জন্য, কোরটা জ্বলে উঠল।
গল্পে শোনা সেই ভূতুড়ে আলো। এক অসম্ভব, অপার্থিব, তীব্র নীল আভা যা বিস্ফোরণের মতো ঘরটাকে ভরিয়ে দিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন নিজের চামড়ার ভেতর দিয়ে হাতের হাড়গুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আর তার কেন্দ্রে স্নান করছিলেন স্লোটিন, একটা মনুষ্যসৃষ্ট ঈশ্বরের সামনে ছায়ামূর্তি হয়ে। একটা তাপের ঢেউ, যেন জ্বলন্ত চুল্লির দরজা খুলে দেওয়ার মতো, আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। মনে হলো, যেন চামড়ার ভেতর দিয়ে আত্মাটায় ছ্যাঁকা লাগল।
তারপর সব শান্ত। নীল আভাটা মিলিয়ে গেল। ঘরটা আবার আগের মতোই হয়ে গেল। কিন্তু সবকিছুর ভেতরে একটা মৃত্যুশীতল স্তব্ধতা নেমে এসেছিল।
স্লোটিন টলতে টলতে পিছিয়ে এলেন। তার মুখটা ফ্যাকাসে, ছাইয়ের মতো। তিনি আমাদের বাঁচিয়েছিলেন, কিন্তু আমরা সবাই বুঝে গিয়েছিলাম কী ঘটে গেছে। দানবটা তার দ্বিতীয় শিকার নিয়ে নিয়েছে। তিনি আমাদের দিকে তাকালেন, তার শান্ত ভাবটা ছিল এক ভয়ঙ্কর মুখোশ। বললেন, “বেশ, যা হওয়ার হয়ে গেছে।”
তিনি ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে হেঁটে গেলেন আর আমাদের কার কী পরিণতি হতে পারে, তার একটা নকশা আঁকতে শুরু করলেন। কিন্তু এবার, সেই নকশায় আমারও নাম ছিল। এবার, ভূতটা সত্যি হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়েছিল।
লুই নয় দিন যন্ত্রণা ভোগ করেছিলেন। আর আমরা, যারা বেঁচে গেলাম, তাদের চেতনায় সেই নীল আলোর ছাপ চিরকালের জন্য খোদাই হয়ে গেল। অবশেষে ওরা ওটাকে ওর আসল নামে ডাকতে শুরু করল: দানব কোর। ওরা ওটাকে গলিয়ে দিয়েছিল, ওর পরমাণুগুলোকে ছড়িয়ে দিয়েছিল, ভেবেছিল শয়তানের শক্তি হয়তো এতে কমে যাবে।
কিন্তু আমি জানি, তা হয় না। একটা দানবকে টুকরো টুকরো করে ফেললে সে মরে না। ওর অস্তিত্বটা এখন আর প্লুটোনিয়ামে নেই। ওটা এখন আমাদের মধ্যে আছে, যারা সেদিন ওই দৃশ্য দেখেছিলাম। ওটা আজও আমার প্রত্যেকটা নিদ্রাহীন রাতে ফিরে আসে, যখন আমি চোখ বন্ধ করি আর সেই মৃত্যুশীতল, অপার্থিব নীল আলোয় ডুবে যাই।
Share On:
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE