Golpo romantic golpo সোনাডিঙি নৌকো 

সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১


সোনাডিঙি নৌকো

পর্ব ১

স্বামীর মানিব্যাগে অন্য একটি মেয়ের পাসপোর্ট সাইজ ছবি খুঁজে পেল দীক্ষা। তাও মেয়েটি তারই আপন ছোট বোন। দীক্ষা থমকে গেল। শিশিরের মানি ব্যাগে তো তার ছবি রাখা ছিল। সেখানে তৃণার ছবি এলো কোথা থেকে! আর তার ছবিই বা কই? দীক্ষা উল্টেপাল্টে ভেতরটা খুঁজে দেখল, নেই। তার ছবি নেই। এর মানে কি?

দীক্ষার মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। সে তড়িঘড়ি করে ওয়ারড্রবটা ধরে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে। প্রেগন্যান্সির সময় তৃণা এ বাড়িতে আসার পর থেকেই শিশির কেমন যেন বদলে যেতে লাগল। এতদিন দ্বিধাদ্বন্দে থাকলেও আজ দীক্ষা শতভাগ তাই মনে করল।

এক সময় যে মানুষটা অফিস থেকে ফিরেই তার কাছে ছুটে আসত, সেই শিশির এখন আর আগের মতো নেই। অথচ একসময় ঠিক উল্টো ছিল সবকিছু।

শিশির ছিল এমন একজন মানুষ, যার যত্নে দীক্ষা নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে করত। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে এক কাপ দুধ গরম করে দেওয়া ছিল তার রোজকার রুটিন। দীক্ষা যদি ঘুমিয়ে থাকত, চুপচাপ বিছানার পাশে রেখে যেত সে। গ্লাসের নিচে চাপা দেওয়া থাকত মিষ্টি কোনো চিরকুট। দুপুরে অফিসের হাজারটা ব্যস্ততার ভীড়েও মেসেজ আসতো তার নাম্বার থেকে, “খেয়েছিস তো?”
আর সন্ধ্যাবেলা ফিরেই এক দৌড়ে এসে দীক্ষার কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলত, “সারাদিন আমার মনের ভেতর এত দৌড়াদৌড়ি করিস, তোর পা ব্যথা করে না?”

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে দুজন মিলে হাঁটতে যেত ওদের বাসার কাছের লেকপাড়ে। কত দুষ্টুমি করত তখন! দীক্ষার ব্যাগ নিজের কাঁধে নিয়ে মেয়েদের মতো হেঁটে চলার ভঙ্গি দেখিয়ে তাকে হাসাতো। ফুচকা কম্পিটেশন করত। এক ঠোঙায় মুড়ি মাখা খেতে খেতে গল্প করত। দশ টাকার বাদাম কিনতে ভুল হতো না কখনো। ফিরবার পথে ক্লান্ত দীক্ষার হাতে তুলে দিতো একটি টকটকে লাল গোলাপ। সেই গোলাপের পাপড়িতে নিজের অধর ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলত, “ভালোবাসি মহারানী!”
দীক্ষার চোখের কোণে পানি জমত তখন। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী মনে হতো।

শত ব্যস্ততার ভীড়েও অন্তত একদিন কোথাও না কোথাও বেরোতো তারা- কখনো সিনেমা, কখনো চায়ের দোকান, কখনো বা শুধু ছাদের ওপরে বসে তারার গল্প করা। মাসে একদিন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া ছিল ওদের অলিখিত নিয়ম। দীক্ষা নতুন কিছু ট্রাই করত, আর শিশির কেবল তাকিয়ে থাকত তার দিকে। দীক্ষার মুখে হাসি ফুটলেই তার পেট ভরে যেত যেন।

তাদের প্রেমের গল্পও কম লড়াইয়ের নয়। কলেজে প্রথম দেখা, তারপর বন্ধুত্ব, ধীরে ধীরে প্রেম। দীক্ষার বাবা মেনে নেয়নি প্রথমে। শিশিরের সংসার ছোট হলেও চাকরি নতুন, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। কিন্তু শিশির হাল ছাড়েনি। রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে থেকেছে দীক্ষার বাসার সামনের রাস্তায়, শুধু একবার দেখা পাওয়ার আশায়। একদিন হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বলেছিল, “তুই যদি না আসিস, আমি জীবনটাই ছেড়ে দেব দীক্ষা।”

সেই সাহস, সেই ভালোবাসাই শেষে জয়ী হয়েছিল। অনেক বোঝানো, লড়াই, চোখের জলে ভেজা দিনরাত্রির পর অবশেষে ওদের বিয়ে হয়েছিল। কত স্বপ্ন, কত সাজানো সকাল আর নির্ঘুম রাত জড়িয়ে ছিল ওদের জীবনে।

অথচ এখন, তৃণা আসার পর থেকেই যেন সেই পুরনো উষ্ণতার জায়গায় এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এসেছে।
দীক্ষা শুধু অবাক হয়ে ভাবে, “এই কি সেই শিশির, যে একদিন আমার চোখের জল দেখলে পৃথিবী থামিয়ে দিতে পারত?”

তৃণা আসার পর থেকেই ঘরের হাওয়া যেন একটু একটু করে বদলে গেল। শিশির আগের মতো আর হাসে না, কথা বলে না, শুধু দরজার ওপারে এক অচেনা নীরবতা ফেলে রেখে অফিসে চলে যায়।

প্রথমদিকে দীক্ষা ভেবেছিল হয়তো অফিসে কাজের চাপ বেড়েছে, হয়তো ক্লান্তি জেঁকে বসেছে শরীর-মনে। কিন্তু ক্লান্তিরও তো একটা সীমা আছে! আগে যেখানে শিশির অফিস থেকে ফিরে দরজায় ঢুকেই বলত, “দেখ, আজ দোলনচাপা এনেছি। তোর প্রিয় ফুল না?”
সেখানে এখন কেবল মোবাইলের আলোয় মুখ গুঁজে থাকা এক অপরিচিত মানুষ।

অসুস্থ শরীর নিয়েও মাঝে মাঝে দীক্ষা রান্না করে, শিশির নীরবে খায়। মাঝে মাঝে তাকায় কিন্তু সেই দৃষ্টির ভেতর আর আগের উষ্ণতা খুঁজে পাওয়া যায় না।

একদিন দুপুরে ঝুমা বলল,

—“ভাবি, ভাইয়া আজকাল খুব চুপচাপ, কোনো কিছুতেই মন নেই। তোমাদের ভেতর সব ঠিকঠাক তো?”

দীক্ষা হেসে জবাবে জানাল,

—“হ্যাঁ, সব ঠিক আছে ননদিনী। ও কাজের চিন্তায় আছে বোধহয়। তুমি ভেবো না।”

কিন্তু মনে মনে কেমন এক শীতল শঙ্কা জমে উঠেছিল ওর-ও।

তৃণা বেশ মিশুক স্বভাবের মেয়ে। বাড়িতে আসার পর থেকেই সবার মন জয় করে নিয়েছে। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত। শিশিরও প্রথমে তাকে ছোট বোনের মতো বলেই দেখত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু আচরণ বদলে যেতে লাগল। তৃণার সঙ্গে শিশিরের আড্ডা, গল্প, অকারণ হাসাহাসি, আর দীক্ষার জন্য অজুহাতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে লাগল।

এক সন্ধ্যায় শিশির অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ছাদে গিয়ে বসেছিল কিছুটা একান্ত সময় কাটাবে বলে। দীক্ষা প্রথম কিছুক্ষণ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু রাতের প্রহর বাড়তে লাগলে সেও উঠে গিয়েছিল ডেকে আনার জন্য। বাইরে তখন হালকা ঠান্ডা পড়েছে। চারদিকে জ্বর ঠান্ডা লেগেই আছে। কিন্তু সিড়িঘর পর্যন্ত গিয়েই দীক্ষা থমকে দাঁড়িয়েছিল। ভেতরে শিশির একাই না, তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তৃণা-ও। দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, শিশিরের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট, দু’জনের মাথার উপর চাঁদের আলো পড়েছে। কিছু একটা বলছে শিশির, চোখমুখ জুড়ে হাসি, হাসছে তৃণা ও। দীক্ষার বুকটা কামড়ে উঠল সেদিন প্রথম। এই জায়গাটা দীক্ষার ছিল। শিশিরের পাশে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলো গায়ে মেখে হেসে কুটিকুটি হওয়া- একান্তই তার ছিল। অথচ আজ সেখানে তৃণা…. কেন?

মনটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল ওর।
এগোলো না আর। পিঠ ঠেকিয়ে সিড়িঘরেই দাঁড়িয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ঝাপসা চোখের পাতায় কত কিছু উঠে এলো তখন। এই কি সেই শিশির যার জন্য এত যুদ্ধ করে, পরিবারের সঙ্গে মনোমালিন্য করে শেষ পর্যন্ত জোড়া লাগিয়েছিল নিজেদের সংসারটাকে? জয়ী করেছিল নিজেদের সম্পর্ককে। শিশির বলত, “তুই ম রে গেলেও তোর পিছু ছাড়তে পারব নারে মহারানী।”

সময় সব বদলে দেয়।
শেষ পর্যন্ত শিশিরকেও বদলে দিয়েছে।
তবে কি তাকে নিয়ে শিশিরের যত অনুভূতি- তাও বদলে গেছে? দীক্ষার হঠাৎ মাথা ঘুরে ওঠে। চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে। দুনিয়াটা নড়ে উঠে। অস্ফুট স্বরে সে বারকয়েক শিশির শিশির বলে ডাকল ঠিক, কিন্তু সেই ডাক শিশিরের হৃদয়েও গিয়ে কড়া নাড়তে পারল না। শিশির তৃণার দুষ্টু-মিষ্টি গল্পের ভেতর ডুবে গিয়েছে তখন।

নিজেকে সামলে সেদিন নেমে এসেছিল দীক্ষা। কিন্তু এরপর থেকে আর কখনোই সে সহজ ভাবে নিতে পারেনি শিশির তৃণার সম্পর্কটাকে। আর আজকের এই ঘটনা থেকে ভালো কিছু ভাবতেও পারছে না সে। বরং বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না, মানুষটার কাছে সে হঠাৎ করেই এত অবহেলিত হয়ে গেল?

এই কথাগুলি কাউকে বলতেও পারছে না দীক্ষা। কেউ কি বিশ্বাস করবে তার কথা?

ঘরে ছোট ননদ আছে, শ্বাশুড়ি মা আছেন, বড় ভাই-ভাবি- তাদের এক বাচ্চা— সবাই স্বাভাবিক। কেউই তৃণাকে নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি করেনি। দীক্ষার বাবা নেই। মা থাকেন নানা বাড়িতে। তৃণাও সেখানেই ছিল। স্কুল শেষ করে কলেজে উঠেছে এ বছর। তাই শহরে এসেছে ভালো কলেজে পড়বে বলে। যেহেতু দীক্ষা ছাড়া এ শহরে আর কেউই চেনা পরিচিত নেই, তাই এ বাড়িতেই উঠতে হয়েছে তাকে এবং তাতে দীক্ষার শ্বশুর বাড়ির কেউই নেতিবাচক আচরণ করেনি। বরং সবাই খুব সাপোর্ট করছেন। দীক্ষা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, কীভাবে এই ব্যাপার নিয়ে খোলামনে শিশিরের সঙ্গে কথা বলা যায়। বুকের ভেতর চেপে রেখে নিজেরই নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে কেবল!

ছাদে উঠেছে দীক্ষা। ওদের এই বাড়ির ছাদটা বেশ সুন্দর। বাড়িওয়ালার ভেতর শৌখিন ভাব রয়েছে। হরেক রকমের ফুলের গাছ দিয়ে চারপাশ ঘেরাও করে দিয়েছেন। এসে দাঁড়ালে মনটা ফুরফুরে লাগে। সারাবছরই কোনো না কোনো ফুল ফুটে থাকেই। তারচেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার, ইট-পাথরের এই নগরে ছাদের উপর শিউলিতলা। দীক্ষা প্রথম যেদিন দেখেছিল, সে অবাক না হয়ে পারেনি। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো, তার উপর একটি শিউলিগাছ, বেশ ঝাঁক ধরে বড় হয়েছে। যখন ফুল দেয় ভোরবেলা এলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। এখন যেহেতু ফুলের সিজন না তবু দীক্ষা গিয়ে শিউলিতলার নিচে বসল। ঘরের ভেতর আজ-কাল দমবন্ধ লাগে।

শর্মিলাও উঠে এলো একটু পরে, কাপড় গুছিয়ে নিতে। এসে দেখল দীক্ষা চুপ করে বসে রয়েছে। শর্মিলা এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে বসে বলল,

—“শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি?”

দীক্ষা ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটালো,

—“না ভাবি। ঠিক আছি।”

—“এমন দেখাচ্ছে কেন চোখ-মুখ? রাতে ঘুম হয় না?”

—“হয় তো।”

শর্মিলা একটু দোনোমোনো করে বলল,

—“তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”

দীক্ষা জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল।
কণ্ঠ নামিয়ে নিলো শর্মিলা, সচেতন ভাবে বলল,

—“আমার কেন যেন কিছু একটা অদ্ভুত লাগছে দীক্ষা। তুমি আমার বয়সে ছোট, বোনের মতোই, তাছাড়া তোমার এই অবস্থা- সেজন্য বলছি। তুমি কিন্তু পারতে তোমার বোনকে হোস্টেল বা অন্য কোথাও ব্যবস্থা করে দিতে তাই না? কেন যে ওকে এ বাড়িতে…”

দীক্ষা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইলো।
অস্বস্তিতে কা টা হয়ে উঠল শর্মিলার বুকের ভেতরটা।

—“না মানে ও আছে তাতে আমার আপত্তি কীসে! এ বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তার সিদ্ধান্ত তো আমি নেবো না। কিন্তু আমার কেন যেন ভালো লাগছে না। আজ সকালেও তুমি ঘুমিয়ে ছিলে। দেখলাম শিশিরকে চা বানিয়ে দিচ্ছিলো তৃণা। তাড়াহুড়ো করছিল। আমি বাবুর খিচুড়ি বসিয়েছিলাম চুলোয়, আমাকে বলে কিনা চুলা খালি করে দিতে। শিশিরের দেড়ি হচ্ছে। কেমন গিন্নী গিন্নী ভাব। আমার এমনিই মনে হলো, তাই তোমাকে জানালাম।”

শর্মিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল, গলার স্বর আরও নিচু করে বলল,

—“এ সময় এমনিতেই পুরুষ মানুষের ছোঁকছোঁকানি বেড়ে যায়। ঘরে তো পায় না, তাই তারা বাইরে…”

দীক্ষার বুকের ভেতর দামামা বাজছে যেন। ধড়াস ধড়াস করছে হৃদপিণ্ড। ওর চোখজোড়া দেখেই বুঝি শর্মিলা আর কথা বাড়ালো না। দ্রুত হাতে কাপড় গুলো দড়ি থেকে তুলে নিয়ে নিচে নেমে এলো। আসবার আগে শুকনো মুখে দীক্ষাকেও নেমে আসতে বলল তাড়াতাড়ি। তবে দীক্ষা এরপরেও অনেকটা সময় একা একা বসে রইল পা ঝুলিয়ে। দু’চোখ বেয়ে টপটপ করতে থাকা নোনাজলের ধারা ভিজিয়ে দিতে লাগল তার গাল, থুতনি, চিবুক।


শিশিরের আজ ফিরতে দেড়ি হচ্ছে। অন্যদিন এতক্ষণে চলে এলেও আজ তার রিকশার দেখা মিলছে না। তৃণার অস্থির লাগছে। আগামীকাল থেকে তার কলেজের ফার্স্ট টার্ম এক্সাম। কিন্তু পড়ার টেবিলে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। বারবার ছুটে গিয়ে বেলকনির গ্রিল ধরছে। রাস্তায় চোখ বুলাচ্ছে। এই বুঝি দেখা যাবে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে নেমে আসছে শিশির রিকশা থেকে।

দীক্ষা ডাইনিং টেবিলের ওখানে দাঁড়িয়ে পানি পান করছিল। সে অবস্থাতেই তৃণার এই ছোটাছুটি দেখল। কারণটা বুঝতে মোটেই বেগ পোহাতে হলো না তাকে।

দীক্ষা বেলকনিতে এলো।

—“কাউকে খুঁজছিস?”

তৃণা চমকে ওঠা গলায় বলল,

—“না আপা।”

ঘুরে দীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াল।

—“তাহলে এত অস্থির অস্থির করছিস কেন?”

তৃণা ছোট করে বলল,

—“এমনি।”

—“এমনি না, কারণ কি তাই বল।”

—“আগামীকাল পরীক্ষা তো আপা, সে কারণেই..”

—“তাহলে পড়তে না বসে এখানে কি করছিস?”

তৃণা কোনো জবাব দিতে পারল না।
দীক্ষা বলল,

—“যা, গিয়ে পড়তে বস, আর শোন একটা বলি, মায়ের কিন্তু তোকে নিয়ে অনেক আশা… কথাটা মনে রাখিস।”
দীক্ষার কণ্ঠস্বর শক্ত শোনালো। তৃণা চলে গেল নীরবে। দীক্ষা গ্রিল ধরে দাঁড়াতেই দেখল, শিশিরের রিকশা এসে থেমেছে।

আগে যখন তাদের জীবন এমন নীরব,নিটোল ছিল না, চঞ্চলতা ছিল, উষ্ণতা ছিল, স্পষ্ট ভাষায়- প্রেম ছিল, তখন প্রায় সময় দীক্ষা রেডি হয়ে থাকত, শিশিরের রিকশা দেখলেই নিচে নেমে যেতো সুর সুর করে। শিশির এক ভ্রু উঁচিয়ে বলতো,

—“কি চাই মহারানীর?”

দীক্ষা দু’হাত ভাঁজ করে ঠোঁট ভেঙে আহ্লাদী স্বরে জানাতো,

—“চল না একটু হেঁটে আসি এদিক ওদিক। জানি তুই টায়ার্ড, তাও দশ মিনিট, প্লিজ।”

সেই দশ মিনিট কখনো কখনো ঘন্টা খানেক হতো। পুরোনো দিনের সেইসব রোমাঞ্চকর দিনগুলির কথা মানসপটে ভেসে উঠতেই দীক্ষার চোখটা ভরে উঠল। সেই সঙ্গে একটা বুদ্ধি খেলে গেল মুহূর্তেই। ঝটপট যেভাবে ছিল সে অবস্থাতেই গায়ে বড় একটি ওড়না মুড়িয়ে নিয়ে ধীরস্থির ভাবে নেমে এলো নিচে। শিশির সিগারেট নিচ্ছিল, দীক্ষাকে মেইন গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো। একটা মেদুর রঙয়ের ছায়া নেমে এলো চোখ-মুখ জুড়ে।

শিশির বলল,

—“কিছু লাগবে? নিচে এসেছিস কেন? লাগলে ফোন দিলেই হতো।”

দীক্ষা নরম গলায় বলল,

—“তোকে একটা কথা বলব? রাগ করবি না তো?”

—“বল।”

—“একটু হাঁটবি এদিক ওদিক? আমি জানি তুই টায়ার্ড, বেশিক্ষণ নেবো না, জাস্ট দশ মিনিট…”

শিশির স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। দীক্ষার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে। শিশির কি রাজি হবে না? মানা করে দেবে? চোখ জ্বালা করছে। জল ভরে উঠবে উঠবে ভাব। সে আপ্রাণ চেষ্টা করে মুখটাকে হাসি হাসি রাখতে কিন্তু পারছে না। বুকের ভেতরটা পুড়ছে। কতদিন হয়, শিশির তাকে জড়িয়ে ধরে না!

দীক্ষাকে অবাক করে দিয়ে শিশির রাজি হলো। সংক্ষেপে বলল,

—“দশ মিনিট মানে দশ মিনিটই। এক মিনিট বাড়তি না। এগো..”

যত মন খারাপ ছিল, সব মুহূর্তেই উড়ে গেল। কোন জাদুবলে মিলিয়ে গেল হাওয়ায়। খুশি মনে এগিয়ে এসে শিশিরের একটা হাত চেপে ধরল দীক্ষা- যেমনটা আগে ধরে হাঁটার অভ্যেস ছিল ওর। শিশির ছাড়িয়ে নিলো না। টুকটুক করে দু’জনে হাঁটতে লাগল পরবর্তী কিছুক্ষণ।

বেলকনি থেকে ওদের গমন পথের দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল তৃণা। ভাবলেশহীন চোখ-মুখ। শিশিরের হাতের ভেতর হাত গলিয়ে দিয়েছে দীক্ষা। দু’জনের মাঝখানে বাতাস যাবারও ফাঁকটুকু নেই। তৃণার হাতটা গ্রিল ধরেছিল, সে জায়গাটা আরেকটু শক্ত ভাবে চেপে ধরল কেবল।

(চলবে)

সোনাডিঙি_নৌকো (১)

লেখনীতে- #মৃধা_মৌনি

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply