Golpo romantic golpo সোনাডিঙি নৌকো 

সোনাডিঙি নৌকো পর্ব ১০+ খন্ড অংশ


সোনাডিঙি_নৌকো (১০)

মৃধা_মৌনি [শিশির-তৃণা পর্ব]

[এই পর্বটিতে মানসিকভাবে অস্বস্তিকর, ট্রমা-উদ্রেককারী ঘটনা বর্ণনা আছে। যাদের এ ধরনের বর্ণনা মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, তারা নিজের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে পড়বেন]


সকাল থেকেই দুশ্চিন্তায় মাথার ভেতরটা ভার হয়ে আছে তৃণার। একবার ঘরে আসছে, তো আবার গিয়ে দাঁড়াচ্ছে ছাদে। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না কীভাবে শিশিরের থেকে বাইরে যাওয়ার পারমিশন নেবে সে।

তৃণা গিয়ে সহেলির দরজা ধরে দাঁড়াল। সহেলি পাশের রুমে থাকা দীক্ষার বয়সী ভাড়াটিয়া। সে ঘর মুছছিল, তৃণাকে মন মরা অবস্থায় দেখে বলল,

—“আরে, কি হইছে তোমার? মুখ গোমড় কইরা রাখছ ক্যান? জামাইর লগে আবার কাইজ্জা করছনি?”

তৃণা শুকনো হাসি হাসল।

—“না না, এইসব কিছুই না।”

—“তাইলে কি হইছে? জামাইর কাম নাই দেইখা মন খারাপ করতাছ? আরে বোকা মাইয়া, সংসার জীবন কি এতই সহজ? আমি যখন পরথম তোমার ভাইয়ারে নিয়া ঢাকায় আইলাম, কোথাও কোনো কাম নাই, পকেটে একটা টাকা নাই। ছয়শো টাকায় ভাড়া নিলাম এক ছনের ঘর, দুই পাশে কোনোরকমে টিন দাঁড় করানো। তারপর তোমার ভাইয়া কত্ত পরিশ্রম করল… কি গাধার খাটনি! যা পায় তাতেই ঝাপ দিয়া পড়ত। এমনে কইরাই একটা একটা মাল সাবানা করছি। আজকে একটু ভালো পর্যায়ে আছি। একদিনে কিচ্ছু হয় না বুঝছ। আর এত ডড়াইয়ো না। তোমার ভাইরে আমি বলছি তোমাগো কথা। কয়দিন পর তার নতুন বিল্ডিং এর কাম ধরব তখন আরও লোক লাগবো। তোমার জামাইরে নিয়া যাইতে কমুনি। রোজ ৮০০ দিবো শুরুতে। আস্তে আস্তে বাড়বো। খারাপ কি?”

সহেলি আপন মনেই বকর বকর করে যাচ্ছে। তৃণা সেসব মন দিয়ে শুনছেও না। তার মেজাজ অত্যধিক খারাপ লাগছে। একবার ভাবছে রাসেলকে মানাই করে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার পারছে না। একটু বেরোতে পারলে ভালো হতো। কয়টা দিন এই একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে থাকতে থাকতে মন টন একদম বিষিয়ে উঠেছে। আর ভালো লাগছে না। বাইরের খোলামেলা আলো বাতাসের দরকার ছিল।

—“কি গো, কথা কও না ক্যান? আসো ভিতরে আসো। বসো তো ফ্যানটার নিচে… আজকে কি রোউদ উঠছে বাইরে, দেখছ! গরমে ঘামাইয়া শেষ।”

তৃণা আস্তে করে বলল,

—“এইখানে আমার আর ভালো লাগে না। একটু বাইরে যেতে পারলে মনটা ভালো হয়ে যেতো।”

—“আরে তাই কও। আমিও যখন মা বাপ ছাইড়া নয়া নয়া এই শহরে আইছি, আমারও কিছু ভালো লাগত না। সারাদিন মনটা বেজার থাকত। তারপর তোমার ভাই আমাকে কত জায়গায় ঘুরাইতে নিয়া গেছে। হিসাব ছাড়া ঘুরছি। এখন আর ঘুরতে যাইতে মন চায় না। তোমারও আমার মতো অবস্থা, বুঝছি।”

তৃণা চিবুকে থুতনি মিশিয়ে রাখল। সহেলি বলল,

—“আচ্ছা কই যাবা কও? বিকালে আমি আমার মামী শ্বাশুড়ির বাসায় যামু। এই কাছেই, যাইবা? গেলে বিকালে তৈয়ার থাইকো।”

—“কতদূরে?”

—“আরে কাছেই। হাইটা গেলে পনেরো মিনিট লাগে।”

তৃণা ভাবুক স্বরে বলল,

—“দেখি।”

তারপর বেরিয়ে এসে সহেলির কথাটা ভাবতে লাগল। যাওয়া যায়! একবার সহেলির সাথে বের হতে পারলে এরপর যেভাবেই হোক, একটা ব্যবস্থা করে রাসেলের সাথে দেখা করতে যাওয়া যেতেই পারে। আর নিশ্চয়ই সহেলির সাথে যাওয়া নিয়ে শিশিরও না করবে না।

তৃণা ঘরে ঢুকল। দুপুরের চড়া রোদের তাপ এড়াতে ঘরটিতে একটা স্যাঁতসেঁতে শীতলতা আছে বটে, কিন্তু সেটা যেন আরও বেশি দমবন্ধকর। এই অবেলায়ও শিশির একটা পাতলা লুঙ্গি পরে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার গায়ের ঘামে ভেজা গন্ধ আর ঘরভর্তি আলসে নীরবতা তৃণার মেজাজটাকে আরও তিক্ত করে তুলল।

তৃণা আস্তে করে খাটের কোণে গিয়ে বসল। সে জানে, শিশিরকে জাগানোটা একটা চ্যালেঞ্জ। ঘুম থেকে উঠলে তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে থাকে। কিন্তু পারমিশনটা যে নিতেই হবে!

তৃণা আলতো করে শিশিরের পিঠে হাত রাখল।

—“এই… শোনেন না।”

শিশির নড়ে উঠল না। শুধু অস্পষ্টভাবে গুমরে উঠল,

—“আহ… কী?”

—“উঠেন না একটু। কত বেলা হলো দেখেন।”

তৃণা একটু চাপ দিয়ে ডাকল।
শিশির ধড়ফড় করে উঠে বসল। চোখ দুটো লাল, ঘুম জড়ানো।

—“কীসের বেলা? কয়টা বাজে? কী হইছে?”

তার কণ্ঠস্বর যথেষ্ট কর্কশ, যা শুনে তৃণার বুকটা ধক করে উঠল। তৃণা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলল। এই মুহূর্তে রাগ দেখালে সব ভেস্তে যাবে।

—“”আহা! এত রাগ কেন? দেখেন তো চুলগুলো কেমন আলুথালু! আপনাকে একটু ভালোবাসতে এলাম আর আপনি আমার সাথে এমন করছেন?”

তৃণা উঠে শিশিরের এলোমেলো চুলগুলো আলতো হাতে ঠিক করে দিতে লাগল। এই সোহাগের কাছে শিশির সাধারণত দুর্বল।

শিশিরের চোখ কিছুটা শান্ত হলো।

—“সকাল থেকেই মাথা ধরে আছে। মাথার ভেতর শুধুই দুশ্চিন্তা। আর তুমি…”

—“আর আমি কী?”

তৃণা আরও কাছে ঘেঁষে বসল।

—“আমার তো আরও দুশ্চিন্তা। দিনের পর দিন আপনি ঘরের বাইরে যান না। আপনার কাজ না থাকলে আমারও তো ভালো লাগে না। মনটা পচে যাচ্ছে গো! এই খুপরি ঘরে সারাদিন…”

শিশির এবার তার হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনল।

—“তাতে আমার কী করার আছে? কাম তো চাইলেই পাওয়া যায় না।”

—“আপনার কিচ্ছু করতে হবে না।”
তৃণা আহ্লাদ মিশিয়ে বলল।

—“আমার মন ভালো করার জন্য একটা জিনিস করতে পারেন। সহেলি ভাবি একটু পর তার মামী শ্বাশুড়ির বাসায় যাবে। এই তো কাছেই, পনেরো মিনিটের রাস্তা। আমি কি তার সাথে একটু ঘুরে আসতে পারি? মনটা একটু মুক্ত হবে।”

শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকাল।

—“পাশের বাসার ভাবির সঙ্গে?”

—“হুম।”

—“কই যাবা?”

—“আরে বললাম তো, তার মামী শ্বাশুড়ির বাসায়। উনি তো পাশের ফ্ল্যাটে থাকে, চেনা-জানা মানুষ। আমি তো একা যাচ্ছি না, আর বেশিক্ষণ লাগব না। সন্ধ্যার আগে আগে চলে আসব, কথা দিচ্ছি। কী প্লিজ, যেতে দেন না। না গেলে আমার মাথা ধরবে, তখন কিন্তু রান্নাবান্না কিচ্ছু হবে না, বলে দিলাম!”

তৃণাকে অবাক করে দিয়ে এক বাক্যেই রাজি হলো শিশির। ছোট করে শ্বাস ফেলে বলল,

—“যাও। তবে সন্ধ্যা ছয়টার পর যেন তোমারে বাসার বাইরে না দেখি। আর সহেলি ভাবিরে ছাইড়া এক পাও যেন অন্য কোথাও যেয়ো না।”

তৃণার চোখ ঝলমল করে উঠল। শিশিরের কপালে দ্রুত একটা চুমু এঁকে দিয়ে বলল,

—“আপনি এত কিউট কেন? প্রমিস করলাম,আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে শুনব! এখন আমি যাই, রেডি হতে হবে তো।”

পালাবার সুযোগ ও রাসেলের সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়ে তৃণার মনে এখন আনন্দের ঢেউ। সে তড়িঘড়ি করে একটা হালকা নীল রঙের সুতির সালোয়ার কামিজ পরল। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক। অনেকদিন পর বাইরে বেরোবে।

বিকাল হতেই সহেলি এসে ডাক দিল।

—“তিণা, রেডি তো? চলো, রওয়ানা দেই।”

তৃণা কাঁধের ওড়না ঠিক করতে করতে বলল,

—“চলো ভাবি।”

তারা দুজন বেরিয়ে পড়ল। সহেলি স্বাভাবিকভাবেই তার মামী শ্বাশুড়ির বাড়ির রাস্তা ধরে অনর্গল কথা বলতে শুরু করল।

—“আমার এই মামী শ্বাশুড়ি দুনিয়ার বজ্জাত বুঝছ। ভাব এমন করবে যে তোমার জন্য জান কাইট্টা হাজির, কিন্তু তুমি গেলে গাই শুরু হবে বদনাম। মাইয়ার চোখ ভালো না, নজর বেঁকা, কথা কয় বেশি- মানে দুনিয়াদারী…”

তৃণা কিছুই শুনছিল না। তার মন তখন শুধু রাস্তার মোড় আর গলিপথগুলো খুঁজছে। সহেলির মামী শ্বাশুড়ির বাড়ি থেকে উল্টো দিকে মাত্র দুটো গলি পেরোলেই সেই টং দোকানটা, যেখানে রাসেল অপেক্ষা করার কথা।

দশ মিনিট হাঁটার পর তারা যখন বাজারের মোড়ের কাছাকাছি, যেখানে অনেক ভিড়, তৃণা হঠাৎ করে পেটে হাত চেপে ধরে “উফফফ!” বলে গোঙালো।

সহেলি থমকে দাঁড়াল।

—“কী হইছে তৃণা? কী করো?”

—“ভাবি, আমার পেটের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে বাথরুম যাওয়াটা খুব জরুরি। এখুনি না গেলে বিপদ হয়ে যাবে গো!”

তৃণার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল। সে এমন নিখুঁত অভিনয় করল যে সহেলি মুহূর্তেই চিন্তিত হয়ে পড়ল।

—“হায় আল্লাহ! এইহানে তো কোনো পাবলিক টয়লেট নাই! এখন কী করবা?”

তৃণা চারপাশে অসহায়ভাবে তাকাল।

—“ভাবি, তুমি যাও। আমি এই মোড়ে দাঁড়াই। একটা ফার্মেসি আছে না ওইখানে? দেখি যদি একটা গ্যাসের বড়ি পাওয়া যায়…তারপর বাসায় চলে যাবো। প্লিজ, তুমি যাও। আমার আর হাঁটতে ভালো লাগছে না।”

সহেলি দ্বিধাগ্রস্ত হলো।

—“একা ক্যামনে যাইবা? শিশির ভাইরে না কইলাম লগে থাকুম। চলো, আমিও আগাইয়া দেই।”

—“আরে কিচ্ছু হবে না। এই তো কত মানুষ। আর আমি তো রাস্তা চিনে যেতে পারব। তুমি যাও তো! আমি এখনই রওনা হই।”

তৃণার পীড়াপীড়িতে এবং তার ভয়ার্ত মুখ দেখে সহেলি শেষ পর্যন্ত রাজি হলো।

—“আচ্ছা, তাইলে তুমি তাড়াতাড়ি যাইয়ো কিন্তু।”

সহেলি চলে যেতেই তৃণা হাফ ছেড়ে বাঁচল। তার পেট ব্যথা মুহূর্তেই উধাও! সে দ্রুত বাজারের দিক থেকে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। তার হার্টবিট এখন তীব্রভাবে বাড়ছে, শুধু উত্তেজনায় নয়, ধরা পড়ার ভয়ও কাজ করছে।

বাজারের মোড় থেকে একটা অন্ধকার গলি ধরে সে হাঁটল। গলির শেষ মাথায় একটা পুরোনো, রঙচটা টিনের চালার নিচে সেই টং দোকানটা। এটাই তাদের সাক্ষাতের জায়গা।

তৃণা দূরে দাঁড়িয়েই দেখল একটা ছেলেকে। রাসেল!

রাসেল একটা হলুদ টি-শার্ট আর জিন্স পরেছে। মাথার চুলগুলো জেল দিয়ে যত্ন করে আঁচড়ানো। সে একটা সিগারেট ধরাতে যাচ্ছিল, কিন্তু তৃণাকে দেখেই সিগারেটটা ফেলে দিল।

রাসেল তৃণাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল। চোখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা- যেটা আগে কখনো তৃণা খেয়াল করেনি। তৃণার বুকের ভেতর অকারণে একটা শিরশিরে অনুভূতি ঢুকে গেল। তবু সে এগিয়ে গেল, মুখে জোর করে হাসি রেখে।

—“কি অবস্থা দোস্ত? কখন আসছিস? অনেকক্ষণ হলো?”

রাসেল মাথা নেড়ে বলল,

—“না রে, এই মাত্রই আসলাম।। তুই ঠিক টাইমেই আসছিস। চল, এখানে ভিড় বেশি… একটু নিরিবিলি জায়গায় বসে কথা বললেই ভালো হয়।”

তৃণা থমকাল।

—“এখানে না? দোকানের সামনেই তো..”

—“আরে দোকানদার আমার চেনা পরিচিত। চিনলে আবার গল্প শুরু করবে। চল, আমার এক বন্ধুর বাসায় দুই মিনিট যাই। সামান্য হাঁটলেই… তারপর তোর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে দোস্ত। সমাপ্তি কে নিয়ে আর আর পারতেছি না। আমার তোর হেল্প লাগবে।”

তৃণার এখান থেকে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। বরং কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছে… কিন্তু মুখে না বলার সাহস পেল না। তৃণা নিজের মনকে বোঝালো। রাসেল তার ফ্রেন্ড, আর একটা নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে কথা বললে নিজেরই ভালো। কারো দেখার ভয়টা থাকবে না।
এই ভাবনায় নিজেকে স্বস্তি দিয়ে সে রাসেলের সাথে হাঁটতে লাগল।

গলির পর গলি পেরিয়ে তারা ঢুকল একটা পুরনো, আধো অন্ধকার বাড়িতে। দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় তৃণার মনে অনির্বচনীয় একটা ভয় খামচে ধরল। ঘাড়ের পিছনে ঘাম জমল।

দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে আরেকজন ছেলেমানুষ বেরিয়ে এল- গম্ভীর মুখ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তৃণা থমকে দাঁড়াল।

রাসেল হেসে বলল,

—“ভয় পাইস না। ও আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। চল, ভেতরে।”

তৃণা কিছু বলতে চাইল, কিন্তু শব্দ বের হলো না। ভেতরের বাতাসে একটা চাপা, বন্ধ, ভারী গন্ধ। মনে হলো যেন অক্সিজেন কমে গেছে হঠাৎ।

বাড়ির দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনেই তৃণার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেল।

এরপর যা ঘটল- তা এত দ্রুত, এত আচমকা, এত অপরিচিত ক্রূরতার রূপে আছড়ে পড়ল যে তৃণা চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না।

তার প্রতিবাদ, কান্না, চিৎকার সব গিলে ফেলল বন্ধ দরজার পুরু কাঠ।
তৃণা অনুভব করল সে যেন নিজের দেহ নয়, অন্য কারো ছায়া হয়ে গেছে। তার হাত, তার পা, তার কণ্ঠ কিছুই আর নিজের ছিল না। সময় থেমে গেল। পৃথিবী থেমে গেল। শুধু ভেতরে ভেতরে চিৎকার করতে থাকা একটা মেয়ে পড়ে রইল নীরব, ভাঙা, অসহায় অবস্থায়।

যখন সব শেষ হলো তখন তৃণা অনুভব করল, তার গায়ে কেউ যেন লোহা চাপিয়ে দিয়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট। চোখে জল নেই, কিন্তু বুকের ভেতর এক সমুদ্র জোয়ার।

রাসেল ঠাণ্ডা চোখে সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতে মোবাইল। স্ক্রিনে কিছু ছবি ঝলসে উঠল- তৃণার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো।

রাসেলের কণ্ঠস্বরে ভয়াল অনুরণন,

—“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, খুব চালাকি করবি না। আজ যা হইছে যদি কারো কানে যায় তাহলে এগুলো দেখছিস? সব পাবলিক করে দিবো।
তোর শরীর কোথায় কোথায় আমি গেছি সবাই দেখবে। বুঝছস? চুপচাপ বাসায় যা। মুখ খোলার চেষ্টা করলেই শেষ।”

তৃণার ঠোঁট কাঁপল। সে চেষ্টা করেও একটা শব্দ বের করতে পারল না। দরজাটা খুলে গেলে সে যেন নিজের পায়ে নয়, কারো ঠেলাধাক্কায় বাইরে বেরিয়ে এলো।

বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হচ্ছিল সে হাঁটছে না বরং ভেসে যাচ্ছে। পৃথিবীর রং ফ্যাকাসে হয়ে আসছে।
শব্দগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। তার ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, ধুলো হয়ে যাচ্ছে।

গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে তৃণার গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত কাঁপছে। নারীর সবচেয়ে ভয়াবহ, সবচেয়ে অন্ধকার লজ্জার বোঝা আঁকড়ে ধরে সে অন্ধের মতো রাস্তা পার হলো।

বাজারের ভিড়, মানুষের হাঁটা, গাড়ির হর্ন কিছুই শুনতে পেল না।

বাসার দরজায় এসে দাঁড়ালে তার মনে হলো একটা বিশাল, কালো ছায়া তাকে অনুসরণ করছে।
তার সারা শরীর ভারী, বমি আসছে, চোখ ফুঁপিয়ে উঠছে তবু কান্না নেই। সে দরজায় হাত রাখল। আঙুলগুলো কাঁপছে। হৃদপিণ্ড যেন গলার কাছে এসে আটকে আছে।

দরজাটা খোলাই। তৃণা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল-
ভাঙা, চূর্ণ, লাঞ্ছিত, এবং সম্পূর্ণ একা রূপে।


দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই তৃণা যেন এক শীতল, ভারি নীরবতার মধ্যে ডুবে গেল। ঘরটির পরিচিত স্যাঁতসেঁতে শীতলতা আজ আরও বেশি দমবন্ধ মনে হলো। শিশির তখনও ঘুমিয়ে আছে কি না, সেদিকে তাকানোর সাহস হলো না তার। শিশিরের উপস্থিতি আজ তার কাছে এক অসহ্য বিচারকের মতো।

তৃণা একটি শব্দও না করে, ছায়ার মতো দ্রুতগতিতে বাথরুমের দিকে গেল। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ভারী এবং যন্ত্রণাগ্রস্ত। সে লাঞ্ছিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ- তাকে এখন শুধুমাত্র তার লজ্জাই চালিত করছে যেন।

বাথরুমের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সে ফোঁস করে এক দীর্ঘ, কম্পিত শ্বাস ফেলল। ভেতরের আয়নায় নিজের ফ্যাকাসে, বিধ্বস্ত মুখটা দেখেও চোখ ফেরাতে পারল না। সেখানে ভয়, ঘৃণা এবং গভীর অপরাধবোধের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। সে আজ নিজেকে চিনতে পারছে না।

তৃণার চোখ থেকে জল এলো না, কারণ তার ভেতরের যন্ত্রণা এত তীব্রই যে তা কান্নার পথও রুদ্ধ করে দিয়েছে। সে কাঁপতে কাঁপতে কল ছেড়ে দিল। জলের শব্দে তার কান্নার নীরব প্রস্তুতি।

শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়েও সে যেন স্তম্ভিত। তারপর হঠাৎই ভেতরের বাঁধ ভেঙে গেল। ফুঁপিয়ে ওঠার বদলে তার গলা থেকে এক অসহায়, চাপা গোঙানির মতো শব্দ বেরিয়ে এলো। সে চিৎকার করে কাঁদতেও পারল না, কারণ বাথরুমের বাইরের দেওয়ালে তার ভয়, তার লাঞ্ছনা লুকিয়ে ছিল।

চোখের জল নয়, যেন মনের জমাট অন্ধকার গলে গলে পড়ছে। তার সারা শরীর শিহরিত হচ্ছে সেই অপরিচিত ক্রূরতার স্মৃতিতে।

“কেন? কেন রাসেল এমন করল?”— এই প্রশ্নটি তার মস্তিষ্কের গভীরে কীলকের মতো গেঁথে যেতে লাগল। তার তো শুধু একটু মুক্তি, একটু খোলামেলা বাতাস দরকার ছিল! কেন সামান্যতম বিশ্বাসও এমন ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে ফিরে এলো?

সে নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগল। কেন সে প্রথম থেকেই সতর্ক হলো না? কেন সেই বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাবে ‘না’ বলতে পারল না? সে কেন এত সহজেই রাসেলের কথায় বিশ্বাস করল? ওই মুহূর্তে, যখন রাসেল তার ব্যক্তিগত কথার কথা বলেছিল, তখন তার বুদ্ধি, তার প্রতিরোধের সাহস কোথায় ছিল? সেই ঘোরের মধ্যে সে যেন এক অবশ পুতুল হয়ে গিয়েছিল।

তৃণা উন্মত্তের মতো সাবান ঘষতে শুরু করল। তার উদ্দেশ্য ছিল মুছে ফেলা, ধুয়ে দেওয়া। সে ডলে ডলে শরীর পরিষ্কার করতে লাগল – যেন চামড়ার প্রতিটি রন্ধ্র থেকে সেই অসহ্য, ঘৃণ্য স্পর্শের দাগ মুছে যাবে। সে তার কাঁধ, গলা, হাত, সেই লোহার চাপ অনুভব করা জায়গাগুলো – বার বার রগড়াল। জলের ধারা তার গা থেকে সাবান আর ঘামের সাথে লাঞ্ছনার স্মৃতিগুলোও যেন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে।

কিন্তু সে জানে, যত জোরেই ঘষা হোক না কেন, মনের ভেতর যে স্পর্শ, যে বীভৎস দাগ লেগেছে, তা মুছবে না। সেই দাগ গভীর, অদৃশ্য, যা তার সত্তা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

অপমানিত, কলঙ্কিত মনে হলো নিজেকে। তার চেতনা যেন দ্বিধা বিভক্ত- এক অংশ ক্রোধে জ্বলছে, আরেক অংশ ভয়ে কাঁপছে, আর সবটা মিলে এক অসহ্য ভারে তাকে পিষে মারছে।

কাঁদতে কাঁদতে একসময় সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। জল তার শরীর থেকে নয়, যেন ভেতরের ক্ষত থেকে রক্তক্ষরণের মতো বইতে লাগল। সে এখন আর শুধু তৃণা নয়, সে ভেঙে যাওয়া এক আত্মা, যে বাইরে বেরোনোর সামান্যতম আশায় তার সর্বস্ব হারিয়েছে।


সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। বাইরের আলো-বাতাসে একটুক্ষণের জন্য বেরিয়ে আসার উত্তেজনা এখন মৃত, স্তব্ধ। তৃণা যখন ঘরটিতে প্রবেশ করল, তখন তার শরীর থেকে নোনা জল আর সাবানের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল। শিশির তখনও ঘুমিয়ে ছিল, গভীর দুপুরে শুরু হওয়া তার ঘুম ভাঙেনি। তাই তৃণার নীরব প্রবেশ, কাঁপা অবস্থায় আবারক ঘরের ভেতর ঢোকা- কোনোটাই তার নজরে আসেনি।

বাথরুম থেকে বেরোনোর সময় তৃণা একটি পোড়-খাওয়া, পুরোনো সুতির থ্রিপিস পরেছে। শরীর মুছলেও, সে তার আত্মার গভীরে লেগে থাকা দাগ মুছতে পারেনি। চোখজোড়া ভোতা, অনুভূতিহীন, আর ঠোঁট দুটি চেপে থাকায় মুখাবয়বের এক স্থবির কাঠিন্য।

ঘরের ভেতরের অলস নীরবতা ভেঙে গেল শিশিরের নড়াচড়ায়। উপুড় হয়ে থাকা থেকে সে এবার পাশে কাত হলো। চোখ খুলে পাশেই তৃণার অস্বাভাবিক স্থির উপস্থিতি টের পেল।

—“এই… এতক্ষণ কই ছিলা?”

ঘুম-জড়ানো মোটা স্বরে জিজ্ঞেস করল শিশির।
তৃণা কোনো জবাব দিল না। সে ঘরের এক কোণে রাখা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি পান করল। তার গলা ভেতর থেকে শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।

শিশির এবার পুরোপুরি উঠে বসলো। মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলোভাবে ঠিক করে নিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালো। ফ্যানের মৃদু শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো আওয়াজ নেই।

—“কী হয়েছে তোমার? কথা বলছ না কেন? আর… এই অবেলায় আবার গোসল কেন? জ্বর আনাতে চাও নাকি?”

শিশিরের স্বরে স্পষ্ট বিরক্তি।
তৃণা ওড়নার আঁচলটা আরেকটু টেনে নিল। তার কণ্ঠস্বর শুষ্ক এবং প্রাণহীন। দায়সারাভাবে বলল,

—“না। একটু গরম লাগছিল, তাই গোসল করলাম।”

—“গরম লাগছিল? কী হয়েছে তোমার? মুখটা এমন পাথরের মতো করে রাখছ কেন? সহেলি ভাবীর বাড়িতে কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি?”

তৃণার মাথা ভেতর থেকে ভোঁ ভোঁ করছে। প্রতিটি প্রশ্ন তার ক্ষতস্থানে যেন আরও লবণ ছিটিয়ে দিচ্ছে। সে মুখ ঘুরিয়ে জবাব দিল,

—“না, কোনো ঝামেলা হয়নি। কেন, আপনার এত জানতে হবে কেন? ভালো লাগছে না, তাই মুখটা এরকম।”

—“ভালো লাগছে না কেন? কীসের এত ভালো লাগা-না লাগা! আমাকে তো সবকিছু বলতেই হবে। আমি তোমার স্বামী না? তোমার সাথে কী হয়েছে, কী হচ্ছে- সবই আমার জানা দরকার।”

শিশির এবার উঠে দাঁড়াল। তার গলার স্বর ক্রমশ উচ্চ এবং কর্কশ হচ্ছে।

তৃণা এবার মুখ ফিরিয়ে সরাসরি শিশিরের চোখে তাকালো। সেই দৃষ্টিতে মিশে অতৃপ্ত বেদনা আর গভীর নীরব প্রতিবাদ।

—“সব আপনার জানা দরকার, তাই না? তাহলে শুনুন, সারাদিন এই খুপরি ঘরে থাকতে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাইরে বেরোলাম, একটু খোলা হাওয়া নিলাম। এখন আর ভালো লাগছে না, এই! আপনার কি কোনো কাজ নেই? সারাদিন ঘুম আর শুয়ে থাকা? আমার আর সহ্য হচ্ছে না এই ঘর! আপনার মতো অকর্মা মানুষের সাথে আমার আর এক মুহূর্ত ভালো লাগে না!”

কথাগুলো তৃণার মুখ দিয়ে বিষের মতো বেরিয়ে এলো। সে আসলে লাঞ্ছনার জ্বালা এবং নিজের অপরাধবোধ থেকে বাঁচতে শিশিরের উপর ক্ষোভ ঢেলে দিল। এই মুহূর্তে তার ভেতরের সমস্ত যন্ত্রণা ক্ষতি করার এক তীব্র বাসনা তৈরি করেছে।

শিশিরের চোখ লাল হয়ে ওঠে। তার শরীরের শিরাগুলো ফুলে গেল। এতবড় অপমান!

—“কী বললে তুমি? অকর্মা? আমি অকর্মা? কাজ পাচ্ছি না আমি কী করব? আর এত করিৎকর্মা লাগলে আসছ কেন আমার সাথে? তখন হুশ ছিল না?”

—“না ছিল না তো। হুশ ছিল না। থাকলে আপনার মতো একটা মেরুদণ্ডহীন লোকের জন্য নিজের জীবন কে এভাবে নষ্ট করে… ছিঃ”

তৃণা প্রায় চিৎকার করে উঠল।

—“তোমার সাহস কত! তুমই আমাকে মেরুদণ্ডহীন বলো! তোমার মতো মেয়ে… একটু বেরিয়ে কি দুনিয়া দেখে ফেলছ নাকি? এত তেজ আসে কোথা থেকে। আমার ঘরে বসে আমার পয়সায় খেয়ে আবার আমাকেই অপমান করা!”

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই শিশিরের হাত বিদ্যুৎ বেগে উঠে গেল।

চটাস!

এক তীব্র শব্দে তৃণার ডান গালে শিশিরের হাতের ছাপ বসে গেল। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল তৃণার, গালে গরম রক্ত ওঠার অনুভূতি হলো। আঘাতটা প্রত্যাশিত হলেও, তার গভীর লাঞ্ছনা যেন মুহূর্তে ক্রোধের আগুনে পরিণত হলো।

—“মা র লে ন আমাকে? আপনি আমাকে মা র লে ন?”

তৃণা মুহূর্তের দ্বিধা না করে, তার সমস্ত অপমান, লাঞ্ছনা এবং রাসেলের দেওয়া যন্ত্রণাকে এক করে পাল্টা আঘাত হানল। সে দু’হাত শক্ত করে শিশিরের বুকে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে শিশির টাল সামলাতে না পেরে পেছনের দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল।

শিশির আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
সে এবার হিংস্রভাবে তৃণার হাত চেপে ধরল। তৃণা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কাঁপা কণ্ঠে বলল,

—“ছাড়ুন আমাকে! আপনার মতো লম্পট মানুষকে আমি ঘৃণা করি! আপনার কারণে আমার জীবন শেষ…সব শেষ।”

শিশির কথাটার অর্থ বুঝতে পারল না, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ যেন তার ভেতরে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের দুজনের গলার স্বর এবার হিংস্র পশুর মতো হয়ে উঠলো।

শিশির তৃণার হাত চেপে ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল,

—“আমি নষ্ট করছি, আর তুমি কিচ্ছু করো নাই। তোমার জন্য আমার পরিবারের মানুষ আমাকে দু চোখে দেখতে পারে না, আমার জবটা গেল, আমার সম্মান, অর্জন সব শেষ।”

তৃণা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল,

—“তাহলে ছেড়ে দিন আমাকে। ছেড়ে দিন। আমি এক মুহূর্ত থাকব না এখানে আর। আমি চলে যাবো। চলে যাবো। এত অপবাদ মাথায় নিয়ে আপনার সঙ্গে এক ছাদের তলায় আর থাকতে চাই না। চাই না….”

সে নিজেকে মুক্ত করার জন্য পা দিয়ে লাথি মারল শিশিরের পায়ে। শিশির এবার তৃণার দুই বাহু ধরে সজোরে ধাক্কা মারল বিছানার ওপর।

তৃণা বিছানার ওপর পড়ে গেল। তার চোখ থেকে অশ্রু নয়, যেন আগুন ঝরছে। সে উঠে বসার আগেই শিশির তার ওপর ঝুকে এলো। তাদের দুজনের চোখেই এখন ঘৃণা, ক্ষোভ এবং চরম ক্রোধের প্রলয়ঙ্কারী রূপ।


গলির শেষ মাথায় টিনের চালার নিচে সেই পুরোনো টং দোকানটা। সন্ধ্যা নেমে গেছে আরও অনেক আগেই, কিন্তু দোকানের টিমটিমে বাল্বের আলোয় সিগারেটের ধোঁয়া আর চাপা হাসি-কথার এক কুৎসিত পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

রাসেল এবং বিজয় দুটো টুল টেনে বসে আছে। দুজনের হাতেই সিগারেট, তবে রাসেলের টানগুলো দ্রুত এবং অস্থির। সে যেন ভেতরে ভেতরে পুড়ছে। অন্যদিকে বিজয় আরাম করে ধোঁয়া ছাড়ছে, তার চোখে এক ধরনের শীতল, তৃপ্ত ক্রূরতা।

বিজয় একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বাঁকা ঠোঁটে হাসল।

—“কী রে ছোট ভাই, মুখটা এমন শুকনো কেন? তৃণা তো চলে গেল। এখন তো একটু ফুর্তি কর। দেখলি তো, এমন মা ল পয়সা দিলেও পাওয়া যায় না। যা চাইলি, তাই তো পেলি। এখন তো একটু খুশি হ।”

রাসেল সিগারেটটা ঠোঁট থেকে সরিয়ে অস্থিরভাবে চারপাশে তাকাল।

—“খুশি? কিসের খুশি ভাই? আপনার এই চাপ আমি আর নিতে পারছি না। আপনি কবে এই সব বন্ধ করবেন? আর আমার ঋণটা কবে শেষ হবে?”

বিজয়ের হাসিটা এবার আরও দীর্ঘ হলো, তবে তা করুণা বা বন্ধুত্বের হাসি নয়।

—“আরে বাবা, এত অধৈর্য হচ্ছিস কেন? তোকে যে আমি বিশাল একটা অ্যামাউন্ট দিয়েছিলাম, সেটা কি একদিনে শোধ হবে? দেখ, তোর তো কোনো কামাই নেই। তোর বাবার কাছেও টাকা নেই। তুই নিজেই তো বললি, তোর টাকা শোধ করার একটাই পথ- আমার কথা শোনা। তো শুনতে থাক না।”

বিজয় রাসেলের কাঁধে আলতো করে চাপ দিল।

—“আর শোন, টাকা দিলেই পতিতা পাওয়া যায়, ঠিক। কিন্তু সেইখানে এই মজাটা পাবি না রে ছোট ভাই। সেইখানে থাকে একটা পেশাদার হিসেব, কোনো টান নেই, কোনো ভয় নেই, কোনো নতুনত্বের স্বাদ নেই। কিন্তু এইখানে… একটা সরল, সাধারণ মেয়ের বিশ্বাস ভাঙার যে মজা, তাদের চোখের অসহায়তা, এইটা তোকে আরও বড় হতে হবে বুঝতে হলে। আর মজা কি আমি একা নিলাম? তুইও তো নিলি, নাকি?”

রাসেলের মুখটা তিক্ত হয়ে গেল। সে নিজের ভেতরের ঘৃণা চেপে গেল।

—“আমি আর পারছি না ভাই। সমাপ্তি… সমাপ্তিও আমার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে। সে কীভাবে যেন জানতে পেরেছিল যে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। সে আমাকে… সে আমাকে এমন জঘন্য কথা বলল… আমি তাকে সত্যিই ভালোবাসতাম।”

বিজয় মুচকি হেসে সিগারেটে টান দিল।

—“দেখ, ভালোবাসা জিনিসটা হলো বাজারের ফুচকার মতো। মন চাইলে খাবি, মন না চাইলে ফেলে দিবি। আর তুই সমাপ্তিকে সত্যিই ভালোবাসলে, তাকে কি এমন রিস্কে ফেলতে পারতি? সব মিথ্যা, বুঝছোস। টাকাই হচ্ছে আসল ক্ষমতা।”

বিজয় ফিসফিস করে রাসেলের কানের কাছে ঝুঁকে বলল।

—“এখন তোর হাতে আরও একটা বড় তাস। ওই তৃণা। তোর খুব ভালো বন্ধু ছিল, তাই না? দেখলি তো, শেষ পর্যন্ত সেও তোর ফাঁদে পড়ল। তোর কথা বিশ্বাস করে আমার বাসায় গেল। এখন তোর হাতে তার নগ্ন ছবি আছে।”

বিজয়ের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠে। সিগারেটের শেষ অংশটা নিচে ফেলে জুতো দিয়ে পিষে ফেলে।

—“কাল দুপুরে একটা ফোন করিস। দেখি, এরপর কাকে আনিস তুই। তোর কলেজের ফ্রেন্ড সার্কেলে আরও অনেক সে ক্সি মেয়ে বন্ধু আছে, তাই না?”

রাসেল মাথা নিচু করে রইল, তার ভেতরের বন্ধুত্বের সামান্যতম মূল্যবোধ, অনুশোচনা আর ভয় মিলে এক অসহ্য যন্ত্রণা তৈরি করছে। সে জানে, সে এখন শুধু বিজয়ের হাতের পুতুল নয়, সে নিজেই এখন এক ভয়ঙ্কর শিকারি, যার হাতে অনেকগুলি মেয়ের জীবন ও সম্মান সম্পূর্ণভাবে বন্দি। তার পকেটে থাকা ফোনটা যে এখন তার ক্ষমতার প্রমাণ এবং একই সাথে তার পাপের প্রতীক বহন করছে।

(চলবে)


সোনাডিঙি_নৌকো [টুকরাংশ]

দীক্ষা মিনমিন স্বরে শুধালো,

—“জানি না মামী। মাঝে মাঝে নিজেরেই দোষ দিতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যে, আমারই বোধহয় কমতি ছিল কোথাও না কোথাও। নাহয় কেন ও এভাবে… আমাকে একটা কল দেয় না মামী। আমার কথা ছাড়ো, ওর সন্তানটার কথাও ও…একটু কি মনেও পড়ে না মামী? মায়া কেবল আমার একারই? বিয়েটা তো সেও করেছিল। একদিনের জন্য হলেও তো ভালোবেসেছিল। একদিনের জন্য হলেও আমি তার স্ত্রী ছিলাম! তাই না বলো? অথচ এই ভার… এই ভার শুধু আমার একার! কি ভাগ্য মামী!”

দীক্ষা নিঃশব্দে কপাল ঠেকায় জানালার শিঁকগুলায়। রমিলা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেই শীতল স্পর্শে এক সমুদ্র স্নেহ মাখা যেন।

—“আহা রে মা! এইটাই তো নারী জনম। শোনো, এই জগতে মায়া কেবল নারীরই ভূষণ, পুরুষের নয়। পুরুষের মায়া হলো সকালের শিশির- সূর্যের আলো পড়তেই শুকিয়ে যায়। আর নারীর মায়া হলো গভীর নদী- পথ হারানো মানুষ তার স্রোতে ভেসে চলে, কিন্তু নদীর গভীরতা কেউ দেখতে পায় না। তারা মায়ার বাঁধন বোঝে না। তারা শুধু সেই নদীর তীরের ফসল দেখে, কিন্তু নদী যে নীরবে তার নিজের সবটুকু দিয়ে যায়, সেই হিসেব কেউ রাখে না।”

[পর্বটি আসবে আগামীকাল। আমার খুব পছন্দের একটি ক্যারেক্টার- রমিলা মামী! উনার মতো একজন মন পড়তে জানা মানুষ থাকলে মনবাড়ির যন্ত্রণা ভাগ বাটোয়ারা করা যেতো… ]

মৃধা মৌনি

Share On:

TAGS: ,



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 

0 Responses

Leave a Reply