ভবঘুরে_সমরাঙ্গন
পর্ব_৬৪
তাজরীন ফাতিহা
উর্মি ভুঁইয়া শুয়ে ছিলেন। ইদানিং শরীরটা একটু ভালো লাগছে। মনটাও রিফ্রেশ হচ্ছে বেশ। ফোনকলের আওয়াজে উঠে বসলেন। স্ক্রিনে ‘Eiru’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। অনেকদিন পর এই নম্বর থেকে ফোনকল এল। প্রায় বছর পেরিয়েছে বোধহয়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আগে সারাক্ষণ এই নাম্বার থেকে কল আসতো আর এখন বছর পেরিয়ে যায় তবুও আসেনা। তিনি নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে জবাব এল না কোনো। উর্মি ভুঁইয়া কতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললেন,
“হঠাৎ করে এই পাগল মানুষটাকে মনে করার কারণ?”
ইরা ঠোঁট চেপে বলল,
“কেউ একজন বোধহয় ভুলে গেছে তার সাথে আড়ি নিয়েছি আমি।”
“তাহলে কল দেয়ার কারণ?”
“শুনলাম অসুস্থ। মানবতার খাতিরে তো আর বসে থাকতে পারিনা।”
উর্মি ভুঁইয়া ফোঁস করে দম ছাড়লেন,
“ভালো আছিস?”
ইরা অকপটে বলল,
“না”
উর্মি ভুঁইয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
“কেন?”
ইরা মন খারাপ করে বলল,
“আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই বকে।”
উর্মি ভুঁইয়া হাসলেন। মেয়েটা এত অভিমানী। তিনি সান্ত্বনা দেয়ার ছলে বললেন,
“জামাই বকেছে নাকি?”
“প্রতিদিন বকে, ঘাড় ধরে মারে।”
“সেকি? তোর জামাইকে তো দেখতে হচ্ছে।”
“এক নম্বরের খাইস্টা লোক।”
“জামাইকে নিয়ে আসিস একদিন, বকে দেব।”
“তার ছুটিই তো হয়না। খালি কাজ আর কাজ।”
ইরা হঠাৎ মনে করার ভঙ্গিতে বলল,
“আচ্ছা শোনো, উমায়ের আঙ্কেলকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে কেন জানো?”
উর্মি ভুঁইয়া কপাল কুঁচকে ফেললেন। বললেন,
“কি বললি, আবার বল।”
“আরে উমাইয়ার বাবাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। শোনো নি?”
উর্মি ভুঁইয়া বসা থেকে শুয়ে পড়লেন। তার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। ভাইজানকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে কেন? ওপাশ থেকে ইরা অনবরত হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। উর্মি ভুঁইয়া ছটফট করছিলেন। ইমতিয়াজ ভুঁইয়া রুমে ঢুকে উর্মি ভুঁইয়াকে এমন কাতরাতে দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে তাকে ধরে বললেন,
“এই উর্মি কি হয়েছে?”
উর্মি ভুঁইয়া ভাঙা গলায় বললেন,
“ভাইজানকে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।”
ইমতিয়াজ ভুঁইয়া চিন্তিত হলেন। এই খবরটা উর্মির এই কন্ডিশনে তারা কেউই দিতে চায়নি তাহলে জেনেছে কিভাবে? পাশেই ফোন দেখে সেখানে Eiru নাম দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন তিনি। উমায়ের ভুঁইয়ার বড় মেয়ে উমাইয়ার বান্ধবী আর উর্মি ভুঁইয়ার প্রাক্তন ছাত্রী এই Eiru মেয়েটা। সেই সুবাধে ভালোই খাতির এই মেয়ের সাথে উর্মির। তিনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিলেন। মেয়েটা তো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল আবার এতদিন পর ফোনের কারণ কি?
ডাক্তার এসে দেখে গেছেন উর্মি ভুঁইয়াকে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপে উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন। এখন ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। উর্মির মেন্টাল কন্ডিশন কবে ভালো হবে কে জানে? চিন্তায় চিন্তায় প্রেশার বাড়িয়ে ফেলছেন ইমতিয়াজ ভুঁইয়া।
_
নিশাত একমনে পিঁয়াজ কুচি করছে। মাগরিবের নামাজ পড়েই রান্না করতে চলে এসেছে। বিকেলে নুডুলস, চা বানিয়ে দিয়েছিল মেজবাহ আহমেদকে। দুপুরের আয়োজনেও তেমন কিছু ছিল না। নিশাতের মন মানছিল না এমন কম আতিথেয়তায়। এজন্য ইলিশ মাছ ভিজিয়ে রেখেছে। তার হাতের স্পেশাল সর্ষে ইলিশ রান্না করবে। নাহওয়ান কোত্থেকে দৌঁড়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা কি কলো?”
নিশাত কাজ করতে করতেই বলল,
“রান্না করি বাবা।”
“কি রান্না কলো?”
“ইলিশ রান্না করি।”
নাহওয়ান জিহ্বা বের করে বলল,
“মুজা মুজা।”
বলে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেল। নিশাত হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে ইলিশ ছুটেছে কিনা দেখল। মারওয়ান এসে পিছনে দাঁড়িয়ে নিশাতকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। ফুল হাতা সেলোয়ার কামিজ পরিহিত বিশাল ওড়না পেঁচিয়ে পানির কল ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ব্যস্ত রমণি। মারওয়ান গলা খাঁকারি দিল। নিশাত চমকে পিছু ঘুরল। মারওয়ানকে দেখতে পেতেই স্বস্তি পেল। সে ভেবেছে মেজবাহ আহমেদ কিনা। জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বলবেন?”
মারওয়ান সিঙ্কে ভর দিয়ে বলল,
“বলব দেখেই তো এসেছি।”
নিশাত বলল,
“তো বলুন।”
মারওয়ান জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল,
“ওয়েট করো, দেখছ না রেস্ট নিচ্ছি।”
নিশাত ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি কোথায় গিয়েছিলেন যে রেস্ট নিচ্ছেন?”
মারওয়ান ডোন্ট কেয়ার মুডে পা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“কোথাও না। শুয়ে ছিলাম, হেঁটে রান্নাঘর পর্যন্ত আসতে কষ্ট হয়নি নাকি?”
নিশাত হতাশ হলো। এই লোক শুধরাবার নয়। সে আবারও পিঁয়াজ কাটতে পিঁড়িতে বসল। মারওয়ান নিশাতকে বসতে দেখে নিজেও ফ্লোরে আসন গেড়ে বসে পড়ল। নিশাত বলল,
“আপনি কি কিছু বলবেন? আমার কাজে ডিস্টার্ব করবেন না প্লিজ।”
“আমি কোথায় ডিস্টার্ব করলাম? তুমি কাজ করছ করো। আমি কি বাধা দিচ্ছি নাকি?”
নিশাত জবাব না দিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। মারওয়ান বলল,
“এত পিঁয়াজ কাটছ কেন? চোখ জ্বলছে। পাকোড়া বানাবে নাকি?”
নিশাতের হাত থেমে গেল। মারওয়ানের দিকে স্থির দৃষ্টি ফেলে বলল,
“রান্না করার জন্য লাগবে।”
মারওয়ান চোখ পিটপিট করতে করতে বলল,
“তোমার চোখ জ্বলছে না? এমন শান্ত হয়ে কিভাবে বসে আছ?”
“যেভাবে বসে থাকতে দেখছেন সেভাবেই।”
“আশ্চর্য সত্যিই তোমার জ্বলছে না?”
“না।”
“কেন বলোতো? দুজনই মানুষ অথচ একজন কাঁদছে আরেকজন হাসছে ব্যাপারটা বেইনসাফি না?”
“মোটেও না। কারণ আমি এসবে অভ্যস্ত।”
“পিঁয়াজ কাটার সঙ্গে অভ্যস্ত, অনভ্যস্তের কী সম্পর্ক?”
নিশাত বটিতে ঘ্যাচাঘ্যাচ করে একেরপর এক পিঁয়াজ কেটে বাটি ভর্তি করে ফেলতে ফেলতে বলল,
“সম্পর্ক আছে। যেমন আপনার মারপিট করার দক্ষতা আছে। এখন যদি আমি আর আপনি মারপিট করতে বসি অবিয়েসলি আমি হারব কারণ আমি মারপিটে অনভ্যস্ত আর আপনি অভ্যস্ত। যে যে কাজে পারদর্শী সে তো সেই কাজটাই করবে তাই না?”
মারওয়ানের চোখ জ্বালা করছে আর পানি পড়ছে বিরামহীন। সে নিশাতের ওড়নার কোনা দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে ওড়না পুরো ভিজিয়ে ফেলেছে। নিশাত ফিক করে হেসে বলল,
“এখান থেকে যান নয়তো আজকে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবেন।”
মারওয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হাসছ কেন? হাসির কি হলো? বাল! জীবনে কষ্ট পেয়েও কাদিনি অথচ এই বালছালের জন্য আমার চোখের মূল্যবান কতগুলো পানি ঝরে গেল।
নিশাত শান্ত গলায় বলল,
“মুখ খারাপ করবেন না আমার সামনে। আপনার মুখে গালি একদমই মানায় না। মনে হয় অশিক্ষিত, মূর্খ লোক কথা বলছে। আপনি নিশ্চয়ই অশিক্ষিত মূর্খ নন?”
“তুমি আমাকে অশিক্ষিত মূর্খ বলছ?”
“আমি বলিনি, আপনার ব্যবহার বলছে। আমি তো জানি আপনি একজন পোস্টগ্র্যাজুয়েটেড হার্ডওয়ার্কিং পার্সন। সেজন্যই সাবধান করলাম।”
নিশাত হার্ডওয়ার্কিং বলার সময় একটু টেনে টেনে বলল। মারওয়ান বুঝল নিশাত তাকে পিঞ্চ মারছে। সে মুখ গম্ভীর করে বলল,
“আমাকে জ্ঞান দেবে না। এসব জ্ঞান তোমার স্টুডেন্টদের দেবে। আ’ম ইওর হাজব্যান্ড নট ইওর স্টুডেন্ট।”
নিশাত মুখ টিপে বলল,
“ওকে হাজব্যান্ড।”
“এখানে আসাই ভুল হয়েছে। তুমি কথায় কথায় আমাকে অপমান করছ। ভেবেছিলাম গরম গরম পাকোড়া ভাঁজছ বোধহয় এজন্য এসেছিলাম। এখন তো মনে হচ্ছে এসে বিরাট অপরাধ করে ফেলেছি।”
“বিরাট অপরাধই করেছেন। বিকেলে নুডুলস খেলেন। এখন আবার কিসের ভাজাপোড়া? আপনার চাচ্চু এ বয়সেও কত ফিটফাট অথচ আপনি? মোটা হওয়ার শেষ স্তরে আছেন। কয়েকদিনের ভেতরেই ভুঁড়ি টুরি বের হয়ে দিগদারি অবস্থা হবে।”
মারওয়ান হতভম্ব গলায় বলল,
“কিঃ!!”
“জি। যে হারে গোশত আর তেলে ভাজা জিনিস খান অসম্ভব কিছু নয়।”
মারওয়ানের মুখ আলগা হয়ে গেছে বিস্ময়ে।
“তুমি আমাকে এত বড় কথা বলতে পারলে?”
“পারলাম। নিজের দিকটাও তো ভাবতে হবে নাকি? এমনিতেই আমি ছোটখাটো। তারউপর যদি আমার পাশে পেট মোটা জিরাফ হেঁটে যায় যেকোনো মানুষ টিটকারী করবে।”
মারওয়ান আর এক মুহূর্তও বসে রইল না। হনহন করে বেরিয়ে গেল। নিশাত নিঃশব্দে হাসতে লাগল। অদ্ভুত লোক! নিশাত উঠে সর্বপ্রথম বিড়াল ছানাকে খাবার দিল। সময়ে সময়ে খাবার দিতে হয় বাচ্চাটাকে। আদর করে খাবার দিয়ে ঝুড়ি আটকে দিল। ছেড়ে রাখলে ছানাটা বারি খায় এখানে ওখানে।
গরম গরম পাকোড়া ভেজে রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। মারওয়ান মুখ গম্ভীর করে সিগারেট টেনে চলেছে। নিশাত এসে মুখ থেকে সিগারেট টেনে বাইরে ফেলে দিল। মারওয়ান তেঁতে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষে কটমট দৃষ্টিতে নিশাতের দিকে চাইল। নিশাত ফিক করে হেসে মারওয়ানের নাক টিপে ধরল। লোকটাকে রাগাতে বেশ লাগে তার। মারওয়ান মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে গেলেই নিশাত মুখও অপর হাত দিয়ে বন্ধ করে বলল,
“সিগারেটের গন্ধ বেরোচ্ছে নাক মুখ দিয়ে এজন্য বন্ধ করে রেখেছি। আপনার শাস্তিও বলতে পারেন। নিষেধ করার পরেও এসব ছাইপাশ গেলেন কেন? আর খাবেন?”
মারওয়ান এক হাত দিয়ে নিশাতের হাত সরিয়ে বলল,
“একশো বার খাব। এসেছে দেড় ইঞ্চির লিলিপুট আমাকে জ্ঞান দিতে।”
“আচ্ছা পাকোড়া খাবেন না?”
“নো। আমাকে পেট মোটা, ভুঁড়ি ওয়ালা বলেছ সব মনে আছে।”
নিশাত মারওয়ানের দাঁড়ি যুক্ত চিবুক শক্ত করে ধরে বলল,
“এই গোঁফ এত বড় হয়েছে কেন? কেমন দেখায়? এগুলো কাটবেন। এখন সাধু, সন্ন্যাসী সাজার প্রয়োজন কী? আগে নাহয় ভবঘুরে ছিলেন সেজন্য এই লুকটা পারফেক্ট ছিল। এখন তো আপনি হাই ফাই ক্লাসের লোক। এখন চলবেন ক্লাসি লুক নিয়ে। চুল, দাঁড়ি আঁচড়ে সুন্দর ভাব নিয়ে চলবেন।”
মারওয়ান ভ্রু বেকিয়ে বলল,
“ইদানিং মনে হচ্ছে তুমি অতিরিক্ত উড়ছ? ব্যাপারটা কী? ভয় টয় গেল কোথায়? আমার উপরে ছুরি ঘুরাবে না লিলিপুট। তুলে দেব এক আছাড় ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে খালি কাঁদবে।”
নিশাত কোমরে হাত রেখে বলল,
“আছাড় দিন তো। দেখি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাদি কিনা? আমি ছোট বাচ্চা নই মিস্টার যে এসবে ভয় পাব। যান পাকোড়া খান। আমার রান্না শেষ হয়নি এখনো। আপনার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট হচ্ছে। ফলও কেটে রেখেছি। চাচ্চু আর ছেলেকে নিয়ে খান যান।”
নিশাত কথাটা বলে চলে যেতে উদ্যত হতেই মারওয়ান খোঁচা মেরে বলল,
“খালি রান্না আর রান্না। শুয়ে বসে থাকবে তা না দেখায় সে সারাদিন কাজ করে।”
নিশাত হেসে বলল,
“পায়ের উপর পা তুলে খাওয়ার মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি। জন্মালে সারাদিন শুয়ে বসেই খেতাম। আর রান্না হলো নারীর ভালোবাসা। তাদের হাতের জাদুকরী ছোঁয়ায় রন্ধনশিল্প শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে বুঝলেন।”
মারওয়ান হাই তুলে বলল,
“উড়ো বেশি করে উড়ো। উড়ে উড়ে জ্ঞান বিতরণ করো। ঝট করে ডানাটা কেটে রেখে দেব পট করে পড়ে যাবে।”
নিশাতও কম না। এগিয়ে এসে বলল,
“আপনিও বেশি বেশি পকরপকর করুন। ইদানিং বেশি কথা বলছেন। ঘপ করে ঠোঁট দুটো ধরে ঘ্যাচাং করে কেটে রেখে দেব তখন কথা বলিয়েন।”
মারওয়ান চোখ লাল করে কিছু বলতে উদ্যত হতেই নিশাত পগারপার। আরেকটু থাকলে তার ঘাড় মটকে দিতো লোকটা। বাবাগো কি চাহুনি!
মেজবাহ আহেমদ নাহওয়ানকে দেয়ালের দিকে ফিরে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“এই বুটুস, ওখানে কি করছেন?”
নাহওয়ান না ফিরেই বলল,
“ইট্টু লুকাইচি, কুজো।”
মেজবাহ আহেমদ ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখতে পাচ্ছি ভাই।”
“ইননা, চব কালু কালু।”
মেজবাহ আহমেদ নাহওয়ানের বাচ্চামি বুঝতে পেরে তাতে সায় দিলেন। নাহওয়ানকে দেখতে পায়নি এমন ভাব করে বললেন,
“একটা গোলগাল, ফুলো ফুলো, ছোট্টখাট্ট বুটুস হারিয়ে গেছে। পরনে নীল গেঞ্জি ও সাদা প্যান্ট। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি যদি দেখে থাকেন তাহলে দ্রুত আমার সাথে যোগাযোগ করুন।”
কথা শেষ হতেই মারওয়ান ট্রেতে করে ফলমূল, পাকোড়া, চা নিয়ে ঢুকল। মেজবাহ আহমেদ তাকে দেখতে পেতেই হেসে ফিসফিস করে বললেন,
“তোর ব্যাটা লুকিয়েছে দেখ।”
মারওয়ান নাহওয়ানের দিকে ফিরে সরু চোখ করে বলল,
“এই কি করিস?”
নাহওয়ান পূর্বের অবস্থায় থেকেই বলল,
“উফফু, বিশি কতা না। কুজো কুজো।”
মারওয়ান কপাল কুঁচকে বলল,
“এক নম্বরের ব্যাক্কল। অলওয়েজ পশ্চাৎ দেখিয়ে বলে খুঁজো। তখন আন্ডাটাকে চটকে ভর্তা করে ফেলতে মন চায়।”
মেজবাহ আহমেদ জোরে হেসে ফেললেন। মারওয়ান ট্রে রেখে বিছানায় আয়েশ করে বসল। মেজবাহ আহমেদ বললেন,
“আবার নাস্তা কেন? বিকেলে খেলাম না?”
“তোমার বৌমা বানিয়েছে খাও। দুই একদিন খেলে মোটা হয়ে যাবে না।”
“আরে এখন খেলে সারাদিন এসবই খেতে ইচ্ছে করবে। মাশাআল্লাহ বৌমার হাতের রান্না লা জবাব।”
“হয়েছে এত প্রশংসা করতে হবেনা। তিনি জানলে কালই তোমার বাসায় শেফের কাজ নেবে নো ডাউট।”
মারওয়ান নাহওয়ানকে ডেকে বলল,
“এই এদিকে আয়। পাকোড়া খাব জলদি আয়।”
নাহওয়ান ঠোঁট উল্টে বাবার দিকে চাইল অর্থাৎ তাকে খোঁজা হয়নি। মারওয়ান ছেলের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল,
“ওকে লুকা।”
নাহওয়ান ফিচফিচ করে হেসে চোখে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইল। মারওয়ান গরম গরম পাকোড়া একটু ছিঁড়ে মুখে নিয়ে বলল,
“টুকি।”
নাহওয়ানও দৌঁড়ে এসে বাবার গলা জড়িয়ে বলল,
“টুকি টুকি।”
মেজবাহ আহমেদ সব দেখে বললেন,
“ভালোই তো আছিস স্ত্রী, সন্তান নিয়ে।”
মারওয়ান পা দোলাতে দোলাতে বলল,
“হ্যাঁ এবার তুমিও বিবাহ করে ভালো থাকো। কতকাল আর সিঙ্গেল থাকবে? বয়স তো কম হলো না।”
“কি বলিস এসব? বিয়ের বয়স আছে নাকি আর?”
“বিয়ের বয়স না থাকার কি আছে? পুরুষরা যেকোনো বয়সে বিবাহ করতে পারে। বিবাহ করাও একটা আর্ট।”
“তোর ফিলোসফি মার্কা কথা বাদ দিবি? তুই না বিয়ে বিরোধী ছিলি হঠাৎ করে আমাকে বিয়ের জন্য ফুসলাচ্ছিস কেন?”
“বিয়ে বিরোধী ছিলাম কিন্তু তোমরা সবাই আমাকে কুরবানী করে দিয়েছ বিয়ে দিয়ে। বিয়ে যে কত আরাম করেই দেখ হাড়ে হাড়ে টের পাবে।”
মেজবাহ আহমেদ পাকোড়া খেতে খেতে আয়েশ করে বসে বললেন,
“আরামই তো। বসে বসে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছিস, একটা গোলগাল বুটুস পেয়েছিস। বিয়ে না করলে এসব পেতি?”
নাহওয়ান আঙ্গুর মুখে দিয়ে চিবুচ্ছে। বড়দের কথার আগামাথা বোঝার ঘিলু এখনো তার হয়নি। তাই সে মনোযোগ দিয়ে ফল খাচ্ছে। পাকোড়া গরম ওটায় হাত দেয়া যাবে না। ঠান্ডা হলে বাবা এমনিতেই খাইয়ে দেবে। মারওয়ান চাচার সাথে আর তর্কে গেল না। সে পাকোড়া একটু ছিঁড়ে ঠান্ডা করে ছেলের মুখে দিল। নাহওয়ান মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
“মুজা মুজা।”
মেজবাহ আহমেদ বললেন,
“এই তুই মজার বুঝিস কী? মুজা অর্থ কি বলতো?”
নাহওয়ান মাথা চুলকে বলল,
“মুজা মুজা।”
মেজবাহ আহেমদ নাহওয়ানকে কোলে নিয়ে ঠেসে ঠেসে চুমু খেয়ে হো হো করে হেসে দিলেন।
_
ইহাব ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসল। মানহা এক গ্লাস পানি এনে ইহাবকে দিল। ইহাব এক নিমিষে শেষ করে বলল,
“কি অবস্থা? দিনকাল কেমন যায়?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভেজা তোয়ালে আবারও বিছানায় রেখেছেন?”
“আরে খেয়াল ছিল না। লাফিয়ে উঠো না আবার। রিল্যাক্স।”
মানহা কোমরে হাত রেখে বলল,
“আপনার সাথে সবসময় লাফিয়ে লাফিয়ে কথা বলতে হয় তাহলে বুঝুন আপনি কেমন লোক?”
ইহাব মানহাকে টেনে কোলে বসিয়ে বলল,
“কেমন লোক আবার? অবশ্যই রোমান্টিক লোক।”
মানহা কপাল কুঁচকে বলল,
“শুরু হয়ে গেছে।”
“কী?”
“এইযে আপনার উল্টাপাল্টা পাগলপনা।”
ইহাব সুর দিয়ে বলল,
“হে রমণী বুঝবে, আমিহীনা ভুগবে।
ভুগে ভুগে তুমি আমারই খোঁজ করবে।
সহে না যাতনা, তুমি কেন বোঝনা?
মুখ ফুলিয়ে, চোখ টেরিয়ে আর তাকিও না।”
“আপনি কি কবিতার ছন্দে কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন?”
“তোমার সাথে কথা বলতে গেলে অটোমেটিক কবিতা বেরিয়ে আসে বুঝলে রাগীতমা।”
“রাগীতমা কী?”
“সকলের প্রিয়তমা আর আমার রাগীতমা। কারণ আমারটা শুধু রাগ করে।”
মানহা অনেক্ষণ হেসে বলল,
“আচ্ছা আর রাগ করব না। এবার থেকে শুধু হাসব। তাহলে কি রাগীতমা বাদ দিয়ে হাসিতমা রাখবেন?”
মানহার হাসি বন্ধই হচ্ছে না। ইহাব মুখ গম্ভীর করে বলল,
“আর হাসবে না। হাসির কী বললাম?”
মানহা হেসেই বলল,
“কিছুই না। আপনি বরং আরেকটা কবিতা শোনান।”
ইহাব উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলল,
“রোমান্টিক?”
“শোনান।”
ইহাব গুনগুন করে বলতে শুরু করল,
“তুমি আর আমি একলা আঁধারে
ডুবে আছি নিশ্চুপ প্রেম মোহতে।
চলো হারিয়ে যাই অজানাতে।
ভালোবাসা বিনিময় হোক সারা রাত্রে।”
মানহা নাক কুঁচকে বলল,
“আর কবিতা পাননি? কিসব কবিতা!”
ইহাব মানহাকে আগলে ধরে বলল,
“রোমান্টিক কবিতা। তুমি এসবের কী বুঝবে? আনরোমান্টিক মহিলা।”
মানহা ইহাবের কোল থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনি খেতে আসুন। আপনার কবিতা আর শোনার প্রয়োজন নেই। কি বিদঘুটে কবিতা!”
বলেই চলে গেল মানহা। ইহাব হতাশ হলো। তার কপালেই এমন নিরামিষ বউ জুটতে হলো। আফসোস!
রাতে ঘুমানোর সময় ইহাব মানহাকে ডেকে বলল,
“ধরো, ডাক্তার দিয়েছে। সকালে উঠে টেস্ট করে জানাবে।”
হাতের বস্তুটি দেখে মানহা লজ্জা পেল বেশ। বলল,
“প্রেগন্যান্সি, বাচ্চা?”
ইহাব মুখ গম্ভীর করে বলল,
“হ্যাঁ, এমন ভাব করছ যেন নতুন শুনেছ?”
মানহার তবুও লজ্জা কমলো না। মিনমিনে গলায় বলল,
“বাবু আসবে?”
“সেটাই তো পরীক্ষা করে বলবে।”
“বাবু, এত তাড়াতাড়ি?”
ইহাব বোকার মতো বলল,
“এ্যাঁ?”
মানহা দ্রুত কাঁথা মুড়ি দিয়ে বলল,
“বিয়ের তো একবছরও হয়নি। এরমধ্যে বাবু? সবাই কি ভাববে?”
ইহাব কিটটা টেবিলে রেখে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল,
“জীবন তুমি কেমন খেলা খেলছ? এ কোন কিসিমের নারী আমাকে দিয়েছ?”
মুখে বলল,
“আমার বয়সী তোমার ভাই নাদুসনুদুস একটা বাচ্চার বাপ আর আমি? জীবন যুদ্ধে কতটা পিছিয়ে আছি জানো? আমার তো উচিত ছিল বিয়ের পরের দিনই বাচ্চা নেয়া। শুধুমাত্র তোমার প্যানিক অ্যাটাকের কারণে কয়েকমাস পিছিয়ে পড়েছি নয়তো দেখিয়ে দিতাম এই ইহাব ভুঁইয়া কোনো অংশে তোমার ভাইয়ের থেকে কম না।”
চলবে…
(আসসালামু আলাইকুম।)
Share On:
TAGS: তাজরীন ফাতিহা, ভবঘুরে সমরাঙ্গন
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৩১+৩২
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৭+১৮
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৪১+৪২
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন ১৫+১৬
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৩+৫৪
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ১৩+১৪
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৭+বোনাস
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব (৫৬.১+৫৬.২)
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব (৪৯.১+৪৯.২)
-
ভবঘুরে সমরাঙ্গন পর্ব ৫৮