তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_৭+৮
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
৭
তাজউদ্দীন সিদ্দিকীর পরিকল্পনা ছিল একটা মেজবান আয়োজনের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি। তাই তাজদার চলে যাওয়ার আগে অন্তত একটা ছোটখাটো ফাতেহা দেওয়ার কথা ভাবলেন তিনি। তবে সেই সামান্য আয়োজনই অপ্রত্যাশিতভাবে বিশাল অনুষ্ঠানে রূপ নিল। ছোট গরু কেনার ভাবনা নিয়ে শুরু করে তিনি আরও বিপাকে পড়লেন। আয়োজন বড় হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাড়তি মাংস কেনার কথা চিন্তা করতে হলো।
এদিকে তাজদার প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিল। কারণ মহিষ কেনা হয়নি। সে প্রথম থেকেই জোর দিয়েছিল মহিষ কেনার ওপর।
তার এমন আচরণে শায়না হতবাক। এত বড় একজন মানুষ সামান্য মহিষ না কেনার কারণে বাবা-ভাইয়ের ওপর রাগ করে বাড়িতে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত করেনি। কী অদ্ভুত ব্যাপার!
যেদিন গরু কিনে আনা হলো সেদিন সারাদিন তাজদার বাড়ি ফেরেনি। সন্ধ্যায় যখন সে বাড়ি ফিরলো তখন তার চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। রওশনআরা শায়নাকে সতর্ক করে দিলেন, “এখন ওর সামনে যেও না। কখন কী বলে ফেলে। যাওয়ার আগে কোনো অশান্তি না হোক।
দাদীমাও তাকে সাবধান করলেন, “ভাবের সময় আদর। ভাব ফুরালেই বাঁদর। রাগ কমুক তখন যেও। তার গায়ে এখন রাগপোকা কিলবিল করছে।”
শাইনা তবুও সাহস করে তাজদার সিদ্দিকীর কাছে গেল। তাজদার তখন ঘরের মেঝেতে পায়চারি করছিল। শায়না দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখল তার মুখাবয়বের অবস্থা ভয়াবহ। চোয়ালের রেখা কঠিন, ভ্রু কুঁচকে আছে। মনে হলো সেই পুরোনো, কটুভাষী তাজদার সিদ্দিকী পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে। এই ধারণাই নিয়েই তীব্র বাক্যবাণ শোনার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে শায়না দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল।
তাকে দেখামাত্রই তাজদার সিদ্দিকী ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। আবারও চোখ সরিয়ে নিল।
শাইনা তার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনার জন্য কফি আনবো?”
তাজদার সিদ্দিকী আবারও তার মুখের দিকে তাকালো। চাহনিতে স্পষ্ট অনীহা ও প্রত্যাখ্যান। কর্কশ গলায় বলল,
“কিচ্ছু খাব না আমি।”
শাইনা দমল না। বরং আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, “ভাত আনি? গরুর মাংস ভুনা। আমি নিজে রান্না করেছি। আনি? ফ্রিজের বাসি মাংস নয়। আজ সকালে আনা হয়েছে। তাজা মাংস।”
তাজদার সিদ্দিকী সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাইনা ঠোঁটে চাপা হাসি এনে খোঁচা মেরে বলল,
“ছোটবেলায় কেউ আমার খেলনাপাতি কেড়ে নিলে আমি ঠিক এমন করতাম।”
কথাটি তাজদার সিদ্দিকীর অহমে তীব্র আঘাত হানলো। সে সঙ্গে সঙ্গে শায়নার দিকে ফিরলো। চোখে বিরক্তির সাথে এক চিলতে কৌতূহলও ফুটে উঠলো।
“কেমন?”
শাইনা তার দিকে আঙুল তাক করে দেখাল, “এমন। মুখ গোমড়া করে রাখতাম। রাগ দেখাতাম।”
তাজদার নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। দ্রুত কয়েকবার চোখের পলক ফেলল, তারপর ঠোঁটদুটো শক্ত করে কিছু একটা বিড়বিড় করলো যা স্পষ্ট শোনা গেল না। তবে তার ভঙ্গিমা দেখে মনে হলো সে নিজের রাগ সামলাতে গিয়ে কোনো সূত্র আওড়াচ্ছে।
শাইনা তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “ভাত আনি তাহলে?”
তাজদার এবার তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর একটু রাগ দেখিয়ে বলল,”তুমি জানো গরুর মাংস বেশি খেলে কী হয়?”
শাইনা হালকা হাসল। তাজদার ধমক দিয়ে বলল,
“হাসবে না একদম। মেরে তক্তা বানিয়ে দেব।”
শাইনা আবারও হেসে ফেলে বলল,”হাসলাম না।”
তাজদার বিড়বিড় করলো।
“হাসছে আবার বলছে হাসলাম না।”
শাইনা বিছানায় গিয়ে বসলো। গালে হাত চেপে বলল,”শুনি গোরুর মাংস বেশি খেলে কি হয়। আপনার মতো করে আমি তো আর পুষ্টিবিজ্ঞানের বই মুখস্থ করিনি।”
তাজদার শাইনার ব্যঙ্গ অগ্রাহ্য করে দ্রুত পায়চারি করতে করতে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করলো, “ব্যঙ্গ নয় মমতাজ। মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই গরুর মাংসে যে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে সেটা মহিষের চেয়ে অনেক বেশি। তুমি জান এই ফ্যাট আমাদের শরীরের লো-ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন, কোলেস্টেরলের মাত্রা হু-হু করে বাড়িয়ে দেয়? আর এই এইসব আব্বুর মতো হার্টের রোগীর জন্য ঠিক কতটা বিপজ্জনক?”
শাইনা বলল,”তারপর?”
তীক্ষ্ণ কণ্ঠে সে প্রায় চিৎকার করে উঠল, “আর ইউ কিডিং মমতাজ?”
শাইনা অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলল,
“না আমি সিরিয়াস।”
তাজদার কাঠকাঠ গলায় বলল, “গোরুর মাংসের চর্বির কারণে রক্তচাপ বেড়ে যায়। আব্বুর জন্য এটা মারাত্মক ঝুঁকি! তোমার ক্ষেত্রেও সেম। তোমার এখন প্রেগন্যান্সি চলছে। এই সময় অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরে গেলে প্রি-এক্লাম্পসিয়ার ঝুঁকি বাড়বে। মহিষের মাংসে আয়রন, প্রোটিনের ডেনসিটি প্রায় একই হলেও ফ্যাট প্রোফাইল অনেক ক্লিন। You need to understand Mumtaj. You must! You need to understand which is beneficial and which is harmful!
শাইনা মনোযোগ দিয়ে শুনল, মাথা সামান্য দোলাল। তাজদার একটুখানি বিরক্তি লুকিয়ে যুক্তি দিয়ে তাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করল। শাইনা তার গালে আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল,”এতকিছু তো ভেবে দেখিনি।”
তাজদার তার দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলল,
“বিষয়টা যতটা তুমি ভাবছ, তার চেয়ে অনেক জটিল। এই ফ্যামিলিতে বরাবরই আমার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ওরা ইচ্ছে করেই গোরু কিনে এনেছে।”
শাইনা অবাক হয়ে বলল,
“আপনার সাথে ওদের কীসের কম্পিটিশন?”
“আস্ক দেম।”
শাইনা একটু খোঁচা দিয়ে বলল,
“সত্যি সত্যি জিগ্যেস করবো?”
তাজদার খেপাটে দৃষ্টিতে তাকাল। শাইনা ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বলল,
“আপনি যখন আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখনও নিশ্চয় ওরা এমন বলেছিল।”
তাজদার স্বীকার করল,
“এগজ্যাক্টলী এগজ্যাক্টলী!”
বলতে বলতে সে শাইনার দিকে ঝুঁকে এল। শাইনা চোখ গোলগাল করে তাকিয়ে বলল,
“ভীষণ অন্যায় হয়েছে। বাবুমশাইয়ের সঙ্গে এত অন্যায় মানা যায়?”
তাজদার অবাক চোখে তাকাল। শাইনা মমতাজ তার সঙ্গে মজা করছে? সে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
“ইউ স্টুপিড!”
শাইনা সরাসরি বলল,”হুম।”
“আবার স্বীকারও করছে! কি নির্লজ্জ!”
শাইনা মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,
“যাওয়ার আগে যে এত চিল্লাপাল্লা করছিলেন ওখানে গিয়ে কিন্তু সবাইকে মিস করবেন।”
তাজদার চটপট উত্তর দিল,
“আমি কাউকেই মিস করবো না। তুমি আমাকে চেনোই না। ওখানে গেলে এখানকার কথা আমার মনে থাকেনা।”
শাইনা সরাসরি বলল,”মিথ্যুক।”
“হোয়াট?”
“আপনি মিথ্যুক।”
“তুমি সরাসরি মিথ্যুক বলতে পারছ?”
“হ্যাঁ।”
তাজদার সরাসরি বলে দিল,”আমি মেজবানের দিন থাকবোই না।”
শাইনা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল,”ভালোই হবে। আমি একটু আরাম করে মাংস খেতে পারবো। “
তাজদার হাঁ করে তার দিকে চেয়ে রইলো। কপাল চেপে ধরে বলল,
“What a savage!”
শাইনা চুল বাঁধতে বাঁধতে বলল,”আমি চর্বিগুলোও আরও বেশি করে খাই। ভাসুরকর্তাকে বলবো বেশি করে চর্বি দিয়ে ভাত এনে দিতে। পেটভরে খাব। আহা, আহা।”
তাজদার চেয়ারে বসে রইলো পিঠ করে। বলল,
“ওইদিন আমি মেজবানে থাকবো না। এই ঘরে বসে থাকবো তোমাকে নিয়ে।”
কথাটা শুনে শাইনা হাসতে লাগলো। তাজদার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো তাকে হাসতে দেখে। শাইনা হাসি চাপা দিতে গিয়ে আরও বেশি করে হাসতে লাগলো।
মেজবানে অনেক মানুষ হয়েছে। শাইনার মামার বাড়ি, তার বোনদের শ্বশুরবাড়িতে পর্যন্ত দাওয়াত করা হয়েছে। এইসব লিস্ট তাজদার সিদ্দিকী ধরিয়ে দিয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ির কতজনকে দাওয়াত করা হবে সেটা সে ঠিক করেছে। শাইনার মনে হয়েছিল ইচ্ছে করেই লিস্টটা বাড়িয়েছে। এত বদলোক সে জীবনে দেখেনি।
তাজউদ্দীন সিদ্দিকী কিছু বলতে চাইলে রায়হান, তৈয়ব উদ্দিন সিদ্দিকী থামিয়ে দিয়েছিল। ওর যেমন ইচ্ছা তেমন করুক। এভাবে এভাবে লোকজন বেড়ে গিয়েছে। তাজদারের মতে মানুষ তাদের বাড়িতে রোজ খেতে আসবে না। একদিনই আসবে। তাই আয়োজনও তেমন হওয়া চায়।
তার কথার পিঠে আর কেউ কথা বলেনি। সবাই চাইছে যাওয়ার আগে কোনো ঝামেলা না হোক। এতদিন সব কিছু বেশ ভালোভাবেই চলছিল। কিন্তু মেজবানের বিষয়টি উঠে আসার পর, তাজদার সিদ্দিকীর সঙ্গে সকলের সরাসরি কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। খোলামেলা আলাপচারিতা আর নেই। সবই এখন তাজদারের আড়ালে কথা বলছে। শাইনা কিছু করতে পারছে না, সইতেও পারছে না।
মেজবানের দিন শাইনা একটা ঢিলেঢালা সেলোয়ার-কামিজ পরে হালকা সেজেগুজে বাড়ির পেছন দিয়ে তাদের বাড়িতে গেল। সেখানে আপার শ্বাশুড়িরা, তার মামা মামীরা, ফুপুরা এসেছে। সবাই ওই বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাকে দেখে সবাই খুশি হলো।
শাহিদা বেগম বললেন, শারমিলার শ্বাশুড়ির জন্য ভাত পাঠিয়ে দিতে। ওখানে ঝামেলার মধ্যে গিয়ে লাভ নেই। ঝামেলা কমলে তখন যাবে।
শাইনা আশ্বাস দিল। সে তৌসিফ ভাইয়াকে বলবে।
বাড়ি এসে সে তৌসিফকে খুঁজে পেল না। দৌড়াদৌড়ির উপর আছে। তিতলি তাকে খুঁজে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ভাইয়ে বাবুর্চিদের ওখানে। অনেক লোকজন সেখানে। আমি যেতে পারবো না। বড়ো ভাইয়া বকবে।”
শাইনা বলল,”উনাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“আমাকে বলো।”
তাজদার সিদ্দিকী তার মামাতো ভাইবোনের কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চাকে নিয়ে আসছিল খাইয়েদাইয়ে। ওরা হাত ধোবে। হাতে এখন তেল লেগে আছে।
তাকে আজ সবকিছুতে অংশগ্রহণ করতে দেখে শাইনার ভালোই লাগছে। সে ভেবেছিল মেজবানের দিন থাকবেই না। সবাইকে আপ্যায়ন করছে দেখে শাইনা চিন্তামুক্ত হলো অনেকটা।
তার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো শাইনা। তাজদার শুনলো না। তিতলি ফিক করে হেসে উঠে বলল,
“এটা আবার কেমন ডাক? ওগো বলে ডাকো।”
শাইনা তার পিঠে চড় মেরে চলে গেল। দ্রুত গতিতে হেঁটে পেছন থেকে তাজদারের পাঞ্জাবি খামচে ধরলো।
তাজদার চট করে তার দিকে ফিরলো। শাইনা বলল,”একটা কথা।”
“কি?”
তাজদার মাথাটা অনেকটা শাইনার দিকে হেলে দিল। শাইনা তার কানের কাছে বলল,
“আপার শ্বাশুড়িদের জন্য ওখানে ভাত পাঠিয়ে দিলে ভালো হবে।”
“ওকে।”
“আরেকটা কথা।”
“কি?”
তাজদার কান শাইনার আরও কাছে নিয়ে গেল। শাইনার নাকে তার কানের ঠোকা লাগলো। শাইনা বলল,
“আপনি দুলাভাইদের সাথে খেতে বসবেন।”
“আর কিছু?”
“বাড়িতে গিয়ে একবার সবার সাথে দেখা করে আসবেন। এখানে এসে আপনাকে কেউ পায়নি।”
“আর?”
“আপনাকে পাঞ্জাবিতে মমতাজের বর বর লাগছে।”
বলেই শাইনা সরে গেল। তাজদার তার যাওয়ার পথে চেয়ে বলল,
“হ্যালো!”
শাইনা ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তাজদার তার উঁচু হওয়া পেটের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
“উনি কিছু খেয়েছেন?”
“উনার মম কিছু খাননি।”
“সাবাশ! কি চমৎকার স্বীকারোক্তি।”
“মাথা! বাড়ির কেউ খায়নি। সবার আগে আমি খেয়ে নেব। মাথা খারাপ আমার।”
তাজদার দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,”বোকাচণ্ডী।”
“বুঝলাম।”
তিতলি দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকামাত্রই দেখলো শাইনা বিছানায় বসে ধীরেধীরে খাচ্ছে। তিতলি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
“এই রে কাজ সেড়েছে!”
শাইনা চোখের ইশারায় বলল,”তোমার ভাইয়া মুখ ধুচ্ছে।”
তিতলি জিভে কামড় দিল। তার পিছু পিছু তৌসিফ ঢুকে এল ঘরে। তিতলি বলল,
“দেখেছ বর হলে এমনই হওয়া উচিত। সবার আগে বউকে এনে খাওয়াচ্ছে। ভাই আমার বিয়ে হয় না কেন?”
তৌসিফ তার ঘাড় ধরে বাইরে ঠেলে বের করে দিয়ে বলল,”মেঝ ভাই আছে। গাধী।”
তিতলি আবারও বলল,”ভাই আমাকে বিয়ে দাওনা কেন? আমার এইসব দেখে মন মানে না।”
“লাথি খাবি?”
“পেট খালি। আগে ভাত খাই তারপর পেট খালি থাকলে দেখা যাবে।”
তৌসিফ হতাশ হয়ে শাইনার দিকে তাকিয়ে বলল,”বের হলে ভাইকে বলো নিচে ডাকছে।”
শাইনা মাথা নেড়ে বলল,”ওকে।”
“রান্না ভালো হয়েছে না?”
“হুম।”
“বড়ো ডেগচি এখন নামানো হয়েছে। সেখান থেকে প্রথম মাংস তোমার পাতে এসেছে। আমি ভাবলাম অন্য কারো জন্য। এখন দেখি বউয়ের জন্য নিয়ে এসেছে!”
বলতে বলতে তৌসিফ হেসে ফেললো।
শাইনা লজ্জা পেয়ে গেল। তিতলি তৌসিফের পেছন থেকে বলল,
“বলছিলাম কি একটা মাংস দেয়া যাবে?”
শাইনা বলল,”নিয়ে যাও।”
তৌসিফ তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে শাইনাকে বলল,”তুমি খাও। বেয়াদবটাকে সাইজ করে আসি।”
তিতলি আর না পেরে নিচে বসে পড়লো। বলল,
“যাব না।”
তৌসিফ হাত ধরে টানতে টানতে বলল,”চল এখান থেকে।”
তিতলি বসে রইলো নিচে। তৌসিফ তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
তাজদার মুখহাত ধুয়ে ঘামে পাঞ্জাবিটা পাল্টে ফেললো। তারপর শার্ট পরতে পরতে শাইনার দিকে তাকালো। আনমনা হয়ে একটা হাড্ডি চিবিয়ে যাচ্ছে সে। তাজদার বলল,
“হ্যালো! সমস্যা কি?
শাইনা হকচকিয়ে তাকালো। বলল,”খাবেন?”
“নো।”
“খান।”
“না বলেছি না?”
“আমি খেতে পারছিনা এতগুলো। এঁটো করতে মন চাইছেনা।”
তাজদার কিছু বলছেনা দেখে শাইনা বলল, “আমি ঘাঁটাঘাঁটি করিনি এই পাশের গুলো। আমার হাত ময়লা না। আমি ছোটবেলার মতো নেই এখন।”
তাজদার চট করে তার দিকে ফিরলো। কথাটা নিজের বোধগম্য হতেই শাইনা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পর তাকাতেই দেখলো তাজদার সিদ্দিকী এখনো চেয়ে আছে ক্ষোভের দৃষ্টিতে।
“কি বললে?”
“খেতে বলছি।”
তাজদার তার সামনে এসে বসলো ধপ করে। শাইনার তার আরেকটু কাছে ঘেঁষে বসে লোকমা বাড়িয়ে দিল। তাজদার লোকমার দিকে তাকিয়ে বলল,”This is top secret, okay?”
“okay.”
শাইনা কথা দিতেই সে লোকমাটা মুখে নিল। চার লোকমা মুখে নিল। তারপর গ্লাস টেনে পানি খেতে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পর সবাই তাকে খুঁজছে। শাইনার দুলাভাই, আনিস, রায়হান, তৌসিফ, আশরাফ সবাই। কিন্তু কেউ খুঁজে পেল না। তাজউদ্দীন সিদ্দিকী বলল,
“ও আসবে না। খাবে না গোরুর মাংসের ভাত। খাবেনা যখন বলেছে তখন খাবে না। কেউ আর ফোন দিওনা।”
তাসনুভার শো-রুমে কাজ করা ছেলে এমপ্লয়িরা এসেছে। তাসনুভা তাদের আপ্যায়ন করছে, হাসাহাসি করছে।
মেজবানে যে ডাল রান্না হয় ছোলার ডাল, মাংস আর লাউ দিয়ে সেই ডালটা সবার বেশ পছন্দ হয়েছে ওটা শেষ হতেই তাসনুভা বাটিটা নিয়ে বাবুর্চির কাছে ছুটলো।
আনিস তাজদারের ফোনে করতে করতে ক্লান্ত। শেষমেশ তৌসিফকে বলল,”আসবে না ও। এখন কল ঢুকছেই না। এটা বড় আব্বুর মিটমাট করে নেয়া উচিত ছিল ওর সাথে।”
আশরাফ বলল,”সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে নিজে না খেয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। এটা কেমন দেখায়? ওকে রেখে সবাই কিভাবে খেতে বসবে। ফোন দিতে থাক। রিসিভ করবে।”
বাড়িতে সবাই তাকে বকে যাচ্ছে। রওশনআরা বলল,”প্রত্যেকবার ছেলেটা একটা একটা ঝামেলা করবে। সবার সাথে বসে খেলে কি হতো?”
জোহরা বেগম বললেন,”ওর বউয়ের ওকে বোঝানো উচিত ছিল না?”
“ও বোঝাবে কেন? বরবউ দুজনেই তো এমন।”
সব দোষ এসে পড়লো শাইনার ঘাড়ে। সে চুপ করে শুনলো সবার কথা। লোকটা ইচ্ছে করেই এমন করে। মাঝখানে সে ফেঁসে যায়।
তাজদার অনেকক্ষণ পর ফোন রিসিভ করেছে। এত কোলাহলের মধ্যে তার কথা শোনা যাচ্ছিল না তাই আনিস ফোন কানে চেপে ধরে সরে যাচ্ছিল সেখান থেকে। ঠিক তখুনি তাসনুভা বাটিভর্তি ডাল নিয়ে টেবিলের দিকে ফিরে যাচ্ছিল ধীরেধীরে। হঠাৎ আনিসের হাতে সঙ্গে তার ধাক্কা লেগে গেল আর ডালের অর্ধেক অংশ ছিটকে আনিসের শার্টে পড়ল। আনিস চমকে উঠলো। ফোন কানে চেপে ধরে শার্টের দিকে তাকাল সে অবাক হয়ে। তাসনুভাও স্তব্ধ! কিছু বলার চেষ্টা করেও মুখ খুলতে পারল না সে।
রায়হান বলল,”এত ভীড়ের মধ্যে কেউ ডালের বাটি নিয়ে যায়? কাউকে বলতে। কি করলে এটা? ওর শার্টটা নষ্ট হয়ে গেল “
তাসনুভা মৃদুস্বরে বলল,”নট সরি।”
নট শব্দটা আস্তে বললেও সরিটা বেশ জোরেই বললো। আনিস কিছু না বলে দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল।
তাসনুভা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে নিজের ঘরে চলে গেল। তার ড্রেসেও ঝোল ছিটকে এসে পড়েছে। শোধ নিতে পেরেছে বলে তার আনন্দ হচ্ছে। আবার বড়ো ভাইয়া থাকায় সরি বলতে হয়েছে দেখে রাগও হচ্ছে। যদিও নট সরি বলেছে। কিন্তু নট শব্দটা আনিস ভাই ছাড়া কেউ শুনতে পায়নি তাই তার প্রতিশোধ ফুলফিল হয়নি। আর আনিস ভাই এত ভাব নিয়ে হাঁটেন কেন? নিজেকে উত্তম কুমার মনে করেন নাকি? দেখলেই গা জ্বলে যায় তার।
চলমান….
তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_৮
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
তাজদার যখন বাড়ি ফিরলো তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। মেজবানের খাওয়াদাওয়া শেষ। বাবুর্চিরা টাকাপয়সার হিসাব বুঝে নিয়ে চলে গিয়েছে। মেহমান অর্ধেক চলে গিয়েছে। অর্ধেক থেকে গিয়েছে।
উঠোনে প্যান্ডেলের নিচে লাল রঙের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে সবাই গল্পগুজবে মেতে উঠেছে। দুই বাড়ির মেহমানই আছে সেখানে।
তাজদারকে দেখে সবাই একসাথে ফিসফিস করে উঠলো। শাইনার খালারা বলল,”জামাই এসেছে।”
তাজদারের হাতে কিছু জিনিসপত্র ছিল। তিতলি এসে সেগুলো হাতে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। তাজদার এসে সবার সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে একটা চেয়ার টেনে বসলো। সবাই নড়েচড়ে বসেছে জামাইয়ের সাথে কথা বলতে। শাইনা মেঝ খালা বলল,”জামাইয়ের গল্প করার জন্য থেকে গেলাম। খাওয়াদাওয়া তো করলেন না।”
তাজদার মাথা নেড়ে বলল,”না খেয়েছি। খাব না কেন? আপনারা থাকুন। সবসময় তো আসেন না। বাড়িতে গিয়েছেন?”
“হ্যাঁ। চা খেয়েই এলাম। আপনার মা দাদীর সাথে কথাবার্তা বললাম। আর ক’দিন আছেন দেশে?”
“দুই দিন।”
“আর বোধহয় থাকা যাবে না।”
“না, অনেক বেশিই থেকেছি। এতদিন থাকার কথা ছিল না। আপনারা থাকুন কয়েকদিন।”
“কালই চলে যাব বাবা। বড়ো মেয়েটার একটা ছেলে হয়েছে। তার শ্বশুরবাড়ি যাব। মেয়েটার একা একা কষ্ট হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ির মানুষ তেমন দেখভাল করেনা। আচ্ছা, আপনি যান। বাড়ির সবাই টেনশন করছে।”
তাজদারের মামীরা বলল,”মামা শ্বশুরের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু।”
তাজদার বলল,”পরেরবার দেশে এলে যাব। এবার পাঁচ মাসই হাসপাতাল কাটিয়ে ফেললাম।”
“এটা কোনো কথা! নতুন জামাইয়ের ব্যাপারই তো আলাদা।”
“সমস্যা নেই। নতুন জামাই সেজে যাব।”
“ঠিক আছে। আমরা মনে রাখলাম।”
তাজদার তাদের সাথে কথাবার্তা বলা শেষে বাড়িতে গেল। কেউ এখন কিছু বলছেনা আর। সবাই তাকে দেখে আরো চুপ হয়ে গেছে যেন সে ভাত খায়নি এটা নিয়ে কারো তেমন ভাবনা নেই।
ঘরে ঢুকতেই শাইনা ঝড়ের মতো ছুটে এল,
“আমাকে বকুনি না খাওয়ালে আপনার শান্তি লাগেনা তাই না?”
তাজদার কপাল কুঁচকে তাকাল। স্বরটা ভারী, সংযত।
“কে কী বলেছে?”
“সবাই এমনকি আমার বাপের বাড়ির লোকজনও বলে যাচ্ছে আমি কেন তাদের জামাইকে বোঝাইনি?”
“অদ্ভুত কথা! আমি কি বাচ্চা ছেলে? আমাকে কেউ বোঝাবে কেন? আর তুমি আমাকে বোঝাবে? ওদের মাথা খারাপ?”
শাইনাও রাগে কাঁপতে লাগল।
“মানে? আমি আপনাকে বোঝাতে পারি না?”
তাজদার হালকা গলায় বলল,”তুমি আমাকে বোঝাতে গিয়ে নিজেই ফায়ার হয়ে যাও।”
“আপনার সঙ্গে আমি আর একটা কথাও বলব না!”
বলতে বলতে শাইনা দরজার দিকে ঘুরতেই তাজদার ঠান্ডা গলায় বলল,
“ওটাই চেয়ে এসেছ সবসময়। এখন আরও সুবিধা হবে। দিনের পর দিন কথা না বলে থাকা যাবে।”
শাইনা থেমে ধীরে ঘুরে তাকাল। কিছুক্ষণ নীরবে তাজদার সিদ্দিকীর মুখখানা লক্ষ্য করল। মুখটা অসম্ভব গম্ভীর। একদমই মনে হচ্ছে না মজা করে কথা বলার মুডে আছে। অথচ কিছুদিন আগেও সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। হাসত, ঠাট্টা করত, এমনকি নিজের কথায় নিজেই হেসে উঠত।
হুট করে কিছু একটা বদলে গেছে। গোরু-মহিষের সেই ইস্যুটা নিয়েই এমন অস্থির? নাকি অন্য কিছু চলছে মাথার ভেতর যে সে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি?
“রাগ করেছেন? আমি সিরিয়াসলি বলিনি।”
তাজদার শান্তভাবে বলল,“তোমার সিরিয়াস না হওয়াটাও একধরনের সিরিয়াস ব্যাপার। রাগ করিনি আমি।”
শাইনা বলল,”তবু চেহারায় রাগ ফুটে আছে।”
“তুমি সেটা দেখতে পেয়েছ এইটুকু আমার সৌভাগ্য। সালাম নাও।”
শাইনা অবাক গলায় বলল,
“আমি এমন কী বলেছি যে আপনি এভাবে…
তাজদার এবার তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল,”বলেছি তো রাগ করিনি। এখন যাও যেখানে যাওয়ার। মাথা খেওনা।”
শাইনা বিছানার উপর শপিং ব্যাগটা দেখলো। হেঁটে এসে সেটা ধরবে তখুনি তাজদার বাঁধা দিয়ে বলল,”ওটা নেবে না খবরদার।”
শাইনা হাত গুটিয়ে নিল। মন খারাপ করে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখুনি তাজদার বলল,”আমি এমন কিছু বলিনি যেটা শুনে তোমার মন খারাপ করবে।”
শাইনা বলল,”আপনাকে বুঝতে পারছিনা বলেই হয়তো মন খারাপ হচ্ছে। অন্য কারণে নয়। যাইহোক এইসব কথা থাক। আপনি দুপুরে আর কিছু খাননি বোধহয়। আমি কিছু নিয়ে আসছি।”
“খিদে লাগলে আমি নিজে নিয়ে খাব। এত বদভ্যাস তৈরি হলে পরে আমাকেই ভুগতে হবে।”
শাইনা অবাক হয়ে গেল। এতক্ষণ পর হয়তো সে বুঝতে পারছে তাজদার সিদ্দিকীর রাগের আসল কারণটা। হঠাৎ বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। সে কি অজান্তেই তাজদার সিদ্দিকীর কাছ থেকে রাগ করার অধিকারটা ছিনিয়ে নিয়েছে?
যে মানুষটা একসময় নিঃসংকোচে রাগ প্রকাশ করত আজ সে রাগ দেখাচ্ছে সাবধানে, মাপজোক করে। নিজেই এখন নিজের রাগের অনুমতি নিচ্ছে। শুধু সে কষ্ট পাবে বলে? এই ভাবনাটাই তাকে হঠাৎ অপরাধী মনে করাল। সে তো কখনো এমন সম্পর্ক চায়নি যেখানে সবসময় ভান করতে হবে, মেকি আচরণ করতে হবে, নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখতে হবে। রাগ, খুশি, সবকিছুই সাবধানে মাপতে হবে যেন কেউ কষ্ট না পায়। কিন্তু তারপরও?
তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাজদার সিদ্দিকী ব্যাগটার দিকে আঙুল তাক করে বলল,”ওটা দেখে নিতে পারো।”
শাইনা ধীরপায়ে হেঁটে শপিং ব্যাগটা হাতে নিল। খুলে দেখলো নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করেছে তাজদার সিদ্দিকী। সাথে তার জন্যও একটা লাল শাড়ি। তবে এটাতে কালো ফুল আছে। অন্যরকম, আরামদায়ক হবে। নিজের অজান্তেই শাইনার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল।
কিন্তু তাজদারের দিকে তাকাতেই হাসিটা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। তার চেহারা এমন গম্ভীর যে শাইনার হাসিটা সেখানে বেমানান।
“আবার আমার জন্য কেনাকাটা কেন?”
তাজদার তার চোখ বরাবর তাকালো প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে। শাইনা বিচলিত হয়ে দ্রুত চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
“পছন্দ হয়েছে খুব। থ্যাংকস!”
বলেই সে শপিং ব্যাগটা আলমারির ভেতরে রেখে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। তাজদারের চোখ আলমারির দিকে আটকে রইল। চাপা রাগ, অপ্রকাশিত অভিযোগগুলো তার চেহারায় কড়াকড়ি কাঠিন্যেতা সৃষ্টি করেছে। শাইনা বাকি জিনিসগুলো দেখলো না!
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল, কিন্তু মনের ভেতরের অচেনা উত্তেজনা আর অব্যক্ত অভিমান চোখের কোণে রাগ হয়ে ঝলমল করতে লাগল। যত চেষ্টাই করুক তা ঢেকে রাখা তার জন্য আর সম্ভব হলো না।
~~~~
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু ল্যাপটপের কি-বোর্ডের মৃদু শব্দ। তাজদার মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। কপালের কাছে কয়েকটা চুল এলোমেলো হয়ে এসেছে, আর বাঁ হাতটা অভ্যাসবশত কানের কাছে রাখা হেডফোনটা একটু আলগা করে দিয়ে সে জটিল ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যাজ কোড কনফিগারেশনে মগ্ন।
ঠিক তখুনি দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে এলেন দাদীমা আনোয়ারা বেগম। হাতে একটা ছোট বাটিতে দুধে চুবানো চালের পিঠা।
নরম গলায় ডাকলেন, “তাজ!”
তাজদার এত মনোযোগে ছিল যে দাদীমার আগমন টেরই পায়নি।
দাদীমা দ্বিতীয় বার ডাকতেই সে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি হেডফোনটা খুলে ল্যাপটপের স্ক্রিনটা সামান্য আড়াল করার চেষ্টা করল।
তারপর উঠে এসে দাদীমার হাত থেকে বাটিটা নিলো।
“তিতলি কোথায়?”
“তৌসিফের সাথে কোথায় গেছে কে জানে। এত শয়তান হয়েছে, এক জায়গায় শান্তিতে বসেনা।”
“শাইনা?”
“রান্নাঘরেই আছে। কাজবাজ করছে বোধহয়।”
তাজদার চুপচাপ খেতে লাগলো।
“তোমার মামী শ্বাশুড়ি এনেছেন এই পিঠা। কেমন?”
“ভালো। একটু বেশিই মিষ্টি হয়েছে। খেতে ভালো লাগছে। খারাপ না।”
দাদীমা একটু থেমে বললেন,
“যাওয়ার আগে এইসব করার কোনো দরকার ছিল?”
“কোনসব?”
“এই যে আজ খেলে না সবার সাথে বসে?”
“সবসময় উচিত কাজ করা যায়?”
দাদীমা হতাশ হয়ে বললেন,
“শাইনার দুলাভাইরা তো বলেই দিল তাদের সাথে খেতে তোমার আপত্তি আছে তাই তুমি না খেয়ে চলে গিয়েছ।”
তাজদার চামচ মুখে না তুলে বলল,”এইসব বাড়াবাড়ি রকমের কথাবার্তা।”
আনোয়ারা বেগম শান্তভাবে বললেন,”এটাই তো স্বাভাবিক। ওরা তো আর জানেনা বাড়িতে কি হ’য়েছে। তোমার এটা করা উচিত হয়নি। যাইহোক এইসব কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তোমার দাদাভাই আর দাদাশ্বশুরের কবর জেয়ারত করিয়েছ আজকে?”
তাজদার বলল,”হ্যাঁ।”
“ভালো করেছ। এবার রাগটাগ বাদ দাও। আর দুটো দিন আছ। ভালো ভালো সময় কাটাও। বউয়ের সাথেও এখন কোনো রাগ দেখিওনা। তুমি চলে গেলে ওর-ও খারাপ লাগবে।”
তাজদার সোজাসাপ্টা বলল,”আমি সিউর ওর খারাপ লাগবে না।
“এটা তোমার রাগের মাথায় বলা কথা।”
তাজদার বলল,”সেটা হতেই পারে তবে এটাই সত্যি।”
দাদীমা হেসে ফেললেন।
“ওর খারাপ লাগলেই তো সমস্যা। তখন তোমার ওখানে মন টিকবেনা। আর সবাই তো একরকম না। ও হয়তো দেখাতে পারেনা। কিন্তু বর দূরে গেলে কষ্ট হবে, সেই বর যদি শত্রু হয় তবুও।”
“তাহলে ভালোই।”
দাদীমা আবারও হেসে ফেললেন।
“মেয়েদের মন বোঝা এত সহজ না। আবার এতটা কঠিনও না। সবাই সবকিছু প্রকাশ করতে পারেনা। আবার অনেকে কথায় না বলে কাজেকর্মে, আচার-আচরণে তা বুঝিয়ে দেয়। শুধু বুঝে নিতে হয়।”
“কেউ আমার জন্য কষ্ট পাচ্ছে এইসব আমার কাছে বিরক্তিকর। এত পেইন নিতে চাই না আমি।”
“এজন্যই তো তোমার জন্য কষ্ট হলেও সবাই তা দেখাতে ভয় করে। এভাবে বলতে আছে নাকি?”
“আমার জন্য কাউকে কষ্ট পাওয়ার ভান করতে হবে না। এইসব ফেইক ইমোশনাল সিন দেখতে চাই না আমি। সেভ দ্যাট ইমোশনাল অ্যাক্ট ফর সামওয়ান হু কেয়ার্স।”
“এত কঠিন কথা বলতে আছে?”
“আমি বলি।”
তখুনি দরজার কাছে শাইনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো তাজদার। শাইনা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। বলল,”দাদুকে বড়ো আব্বু ডেকেছেন।”
আনোয়ারা বেগম একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর তাজদারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তাজদার শাইনার উদ্দেশ্যে বলল,”ভেতরে এসো।”
শাইনা কথা না শুনেই চলে যাচ্ছিল। তাজদার এক লহমায় শাইনার হাত ধরে ঘরের ভেতর টেনে এনে ধড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শাইনা বলল,”ফেইক ইমোশনাল সিন দেখতে চাচ্ছেন?”
কথাটা গরম সীসার মতো তাজদারের কানে বাজল। সে তৎক্ষণাৎ শাইনার হাত ছেড়ে দিল। সে ভুলভাল কথা বললে সেটা শোনার জন্য চলে আসে। কিন্তু তার যে এত খারাপ লাগছে এটা বুঝতে পারছেনা।
তার ভেতরের সব জেদ নতুন করে জমাট বাঁধল। সে দ্রুত হেঁটে গিয়ে দরজাটা আবার খুলে দিল। এবার ইশারায় শাইনাকে চলে যেতে বলল। তার চোখেমুখে চূড়ান্ত বিতৃষ্ণা। শাইনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। চোখে জল নিয়ে ক্ষোভের দৃষ্টিতে তাকাতেই তাজদার বলল,”এই যে ঘর থেকে বেরোলে আমি দেশ ছাড়ার আগে আর একদম ভেতরে আসবে না।”
শাইনা তার কথা অমান্য করে জেদ দেখিয়ে ভেতরে ঢুকে এসে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকের কাছে। কিল, খামচি আর এলোমেলো ধাক্কায় তাজদার দু’পা পেছনে সরে গেল। মুখটা যন্ত্রণায় কুঁচকে গেল।
“কী হচ্ছেটা কী। শাইনা!”
শাইনা শান্ত হওয়ার মেয়ে নয়। তাজদার শেষমেশ তার হাত দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরে শরীরটাকে নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক ঝটকায় শাইনার মাথাটা আলতো করে কাত হয়ে গেলে সে সরাসরি ঠোঁটের উপর ঝুঁকে শক্ত একটা চুমু খেয়ে বলল,
“থামো। বাড়াবাড়ি করো না। রিল্যাক্স!”
চলমান….
Share On:
TAGS: তাজমহল সিজন ২, প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৫+১৬
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৪
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৭+১৮
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৯
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৫
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১১
-
তাজমহল সিজন ২ গল্পের লিংক
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৯
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৬