তাজমহল #দ্বিতীয়_খন্ড
পর্ব_১৯
প্রিমাফারনাজচৌধুরী
শাইনা নিজের ভাইবোন, আর মা বাবাকে দেখে একটু ভরসা পেল। শাহিদা বেগম দোয়াদরুদ পড়ছেন। বলছেন, কাঁদিস না মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আশরাফের বাপ কোথায়। শুনো না। ওর মামুদের একটু খবর দাও না।
আনিস দ্রুত সবাইকে সাইডে সরিয়ে দিল। শাইনাকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে সে শান্ত গলায় বলল,
“এতজন ওখানে গিয়ে কি করবে আম্মা? এখন কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। আমি খবর দেব পরে।”
শাহিদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে হার মেনে নিলেন।
“আচ্ছা আচ্ছা কাউকে কিছু বলছি না।”
শরীরের কাঁপুনিতে শাইনার চোখ বেয়ে শুধু জল ঝরছে। ঘরময় ছুটোছুটি। ব্যাগে রিপোর্ট, কাপড়চোপড় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব গুছিয়ে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। এরই মধ্যে তৌসিফ রায়হান পৌঁছে গেছে। দুই বাড়ির তরুণ-তরুণী আর দুজন মুরব্বি শাহিদা বেগম ও রওশনআরা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তাসনুভা তিতলি আর তৌসিফের সাথে ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছে। সে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে আতঙ্কিত হয়ে। মুখ ফ্যাকাশে। ভয়ে তার হাত পা ঠান্ডা। শাইনার এসব দেখে তার একটা সিদ্ধান্ত আরও পাকাপোক্ত হয়ে গেল সে জীবনেও বিয়ে করবে না। কি ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার। শাইনা নয় মনে হচ্ছে তার শরীরের সমস্ত হাড়গোড় মড়মড় করে ভাঙছে।
ফোনটা শক্ত করে ধরে আছে সে। তাজদারকে একটার পর একটা আপডেট দিচ্ছে, মাঝেমধ্যে বকা খেয়েও যাচ্ছে। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এখানে তার দরকারটা কী। শাইনার ভাইবোনরাই তো সব সামলে নিচ্ছে। ভাইয়া না বুঝেই খালি বকে। রায়হান তাকে হাতের ইশারায় ডাকলো,”নুভা এদিকে।”
সে এগিয়ে গেল,”জি?”
“তুমি যাচ্ছ?”
“হ্যাঁ, আমি ছোটো আর তিতলি একসাথে যাব।”
“আচ্ছা বাকি যা যা লাগে সব গুছিয়ে নিয়ে এসো।”
তাসনুভা তাকে আশ্বাস দিল। সাথে সাথে অপরপাশ থেকে আবারও ফোন এল। রায়হান জানতে চাইলো,”তাজ?”
তাসনুভা মাথা দোলাতেই সে হাত বাড়িয়ে ফোন নিল। ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে এল। রায়হান তাকে আশ্বস্ত করে বলল,”ওদের গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। আমরা যাচ্ছি পরের গাড়িতে। চিন্তার কিছু নেই। সবাই আছে ওখানে। ডাক্তার কি বলে দেখি।”
কথা বলে তাসনুভার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিল সে। পাড়াপড়শিরা উঠোনে জমায়েত হয়েছে।একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছে।
কেউ কেউ বলছে, “বাবাগো বাবা আশরাফের মা’র এই মেয়ে মনে হয় না আর জীবনেও বাচ্চাকাচ্চা নেবে না। একটা হতেই সবাইকে হয়রান করে ফেলেছে।”
পাশ থেকে শাইনার দাদী ধমকালো।
“আহা! এসব কথা বলার সময় এখন? এখন কি আগের যুগ আছে? আগে খাবার দাবারে পুষ্টি ছিল। মানুষ খাওয়াদাওয়া বেশি ছিল। এখনকার মানুষ অত খেতে পারে? খাবারে পুষ্টিও নেই। তাই শক্তসমর্থ কম। পারলে আমার নাতনিটার জন্য দোয়া করো নইলে চুপ থাকো।”
নাতনির জন্য উনার বেশিই চিন্তা হচ্ছে। তিনি মনে মনে কিছু নিয়ত করলেন। নাতনি সুস্থ হয়ে বাচ্চা নিয়ে ফিরে এলে রোযা রাখবেন। তাহাজ্জুদ পড়বেন। কিছু দান সদকা দেবেন।
পরপর দুটো গাড়ি হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দিল। কিছুক্ষণ পরেই এশার আজান দেবে হয়তো। বাড়ির পেছনে নেড়ি কুকুরগুলো একসাথে ডাকাডাকি করছে। দাদীমা শাওনকে বলল,”এগুলোকে তাড়া তো। আমার নাতিটার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। এদের খাইয়ে দাইয়ে পালে কেন বুঝিনা।”
আনিসকেই বকছিলেন তিনি। অফিসে যাওয়ার আগে আর আসার পরে সে কুকুরগুলোকে খাবার দিয়ে যায়। সেগুলো সারাদিন তাদের বাড়িটাকে পাহারা দেয়।
তাসনুভা তাজদারের সাথে কথা বলছে আর ঘরদোর গোছগাছ করছে। এগুলো গুছিয়ে সে হাসপাতালে যাবে। তিতলিকে বলছে কাজ করতে। তিতলি কাজ করবে না। সে জুতো পরছে। সবার আগে সে রেডি। কাজবাজ করতে পারবে না আজ। আজ তার খুশির দিন।
তিতলি রেডি হয়ে বসে আছে। তারা এখানে মন টিকছে না। সে একবার তাসনুভার ঘরে আরেকবার তাশফিন আর তৌসিফের ঘরে ছোটাছুটি করছে। আজ সকালে তাশফিনও এসেছে বাড়িতে। তার এডমিশন টেষ্ট শেষ হওয়ায় সে বাড়ি ফিরে এসেছে।
সে একটু লাজুক। ঝিমলি আর শাইনাকে বেশি লজ্জা পায়। তাসনুভা, তৌসিফকে ভয়। ঝিমলি তাসনুভার ঘরে যাচ্ছিল তখুনি তাশফিনের ঘরে উঁকি দিল। তাশফিন তার ছেলে রুহাবকে সামনে বসিয়ে খেলনার জিনিসপত্র দিয়ে তাকে হাসাচ্ছে।
ঝিমলি উঁকি দিয়ে বলল,"রুহাব সোনা চাচ্চুকে পেয়ে দেখছি সবাইকে ভুলে গেছে।"
তাশফিন ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালো। হাসলো অল্প করে।
রুহাব মায়ের গলা শুনে উঁকি দিল। হাত বাড়িয়ে লাফাতে লাগলো। ঝিমলি মাথা নেড়ে বলল," না, এখন কোলে আসা যাবে না। চাচ্চুর সাথে খেলুন। আমার কাজ আছে। বাই।"
তিতলি বোর হচ্ছে সবার ঘরে ছোটাছুটি করতে করতে। তার এখানে আর একমুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। সে যাওয়ার আগে যদি বাবু এসে যায় তখন? তার খুব ইচ্ছে সবার আগে সে বাবুকে কোলে নেবে। বাবুটা কার মতো হবে? ভাইয়ার মতো নাকি শাইনার মতো? মেয়েবাবু হলে হবে ভাইয়ার মতো। ছেলেবাবু হলে হবে শাইনার মতো। যদিও সে আম্মুর মুখ থেকে চুপিসারে শুনে ফেলেছে ছেলেবাবু হবে নাকি মেয়ে বাবু হবে। কিন্তু যদি ডাক্তারের কথা ভুল হয়?
তাসনুভারও চিন্তা হচ্ছে। ভাইয়া যদি জানতে পারে সে এখনো হাসপাতালে পৌঁছায়নি তাহলে তাকে বকবে। হাসপাতালে যারা আছে সবাই তা জেনে যাবে। তার খুব অপমান লাগবে।
বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। শীত যদিও কিছুদিন পর কমে আসবে। কিন্তু এখন খুব ঠান্ডা পড়ছে। সে ওভারকোট চাপিয়ে তিতলিকে বলল,"তিতলি কোথায় তুমি?"
তিতলি তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে লাফিয়ে এল। তাসনুভা তাকে দেখে মাথায় হাত দিল। তিতলি মোটা একটা সোয়েটার ভেতরে পরে তার উপর একটা ঢিলেঢালা কুর্তি পরেছে। তাকে দেখতে ভীষণ মোটা লাগছে। এমনিতেই সে গুলুমুলু। এভাবে সোয়ােটার পড়ায় আরও..
সে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,
"তিতলি তুমি মানুষ?"
তিতলি দাঁত দেখিয়ে হাসলো।
"ভাইয়ে বলেছে আমি পুতুল। মানুষ না। ইংরেজিতে বলে বার্বিডল।"
তৌসিফ সাথে সাথে ঘরে পা রেখে বলল,"যখন বলেছি তখন তুই পুতুল ছিলি এখন দামড়ি বেটি হয়ে পুতুল সাজছিস? বেয়াদবস!"
তিতলি গালফুলিয়ে তাকালো। তারপর মুখ মোচড় দিল। তৌসিফ তার মাথা চাপড়ে দিয়ে তাসনুভাকে বলল,"তোর সাজগোছ কমপ্লিট?"
তাসনুভা আকাশ থেকে পড়লো।
"কোথায় সাজগোছ করেছি?"
তৌসিফ হার মেনে নিল।
"আচ্ছা করিস নি। চল এবার।"
ঝিনুক এসে রওশনআরা ফোনে যা যা পাঠাতে বললো সব ব্যাগে ভরে নিয়ে এল। তাশফিন তখুনি রুহাবকে কোলে নিয়ে এল।
তিতলি তার গালে চটাস করে একটা চুমু বসিয়ে বলল,"সোনা বলোতো তোমার বোন আসবে নাকি ভাই আসবে?"
রুহাব তার চুল ধরে টেনে দিল। তাসনুভা বলল,"উচিত কাজ করেছে। তুমি ওকে চুমু দিয়েছ কেন?"
তিতলি রুহাবকে ধরে আরও জোরে জোরে চটাস চটাস করে চুমু খেয়ে বলল,"তোমাকে একটা দেব?"
তাসনুভা গর্জাল,"তিতলি!"
তিতলি ফুড়ুৎ করে দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
লন্ডনে এখন গভীর রাত, সম্ভবত মধ্যরাত পার হয়েছে। তাজদার সিদ্দিকী তার পেন্টহাউসের প্রশস্ত লিভিং রুমে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। হাতে কফির মগের শেষ বিন্দুগুলো কখন শুকিয়ে গেছে সে খেয়াল করেনি। পরনে সাদা খয়েরী রঙের একটা পোলো টিশার্ট। এই ঠান্ডার মধ্যেও তার হাতের তালুতে ঘাম।
শাইনা কথা বলার মতো অবস্থায় নেই এই চিন্তাটা তার মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটার মতো বাজছে। প্রথমবার বাবা হওয়ার উত্তেজনা যতটা ছিল, তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি এখন উদ্বেগ।
এই মুহূর্তে সে শাইনাকে স্পর্শ করে সান্ত্বনা দিতে পারছে না এটাই তাকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দিচ্ছে।
সে জানলার কাঁচের বাইরে জমাট বাঁধা কুয়াশার দিকে তাকাল। এখানে শীতের তীব্রতা আরেক রকম। কিন্তু তার মনে এখন যে ঝড় চলছে তার কাছে বাইরের ঠান্ডা কিছুই নয়। সে অনেকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো কাঁচের বাইরে। উদ্ভট উদ্ভট চিন্তাভাবনা আসছে মাথায়। আরেক মগ কফি লাগতো। কিন্তু আলসেমি হচ্ছে।
ফোনটা হাতে নিল সে। গত এক’ঘণ্টায় সে প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর আনিস, রায়হান আর তৌসিফকে ফোন করেছে। প্রতিবারই সে শুধু জানতে চেয়েছে, “এখন কেমন আছে?”
আর উত্তর এসেছে, “এখনও একই রকম।”
সে আবার তাসনুভার নম্বরে ডায়াল করল। তাসনুভার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে হাঁপাচ্ছে।
“ভাইয়া আমরা পৌঁছে গেছি।”
তাজদার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,”এখন কোথায় সবাই?”
“আমরা সবাই হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে আছি।”
“ডাক্তার কি কিছু বলল?”
“শাইনার শারীরিক অবস্থার জন্য নরমাল ডেলিভারি সম্ভব হচ্ছে না। আর অপেক্ষা না করে সি সেকশন করিয়ে নেওয়াটাই সেইফ হবে মা আর বেবির জন্য এমনটা বলেছেন।”
তাজদার চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল। সে বলল, “আনিস আর ভাইয়া কোথায়?”
” ডাক্তারদের সাথে কথা বলছেন।”
তাজদার দ্রুত বলল, “পরিস্থিতি গুরুতর হলে দেরি না করে সি সেকশন করানোই ভালো। ওকে রাখো। আমি ওদের ফোন দিচ্ছি।”
হাসপাতালের করিডোরে উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে সবাই। আনিস আর রায়হান তখন কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। ডাক্তার বলে গেছেন, “আমরা অনেকক্ষণ চেষ্টা করেছি। রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আর অপেক্ষা করাটা ঠিক হবে না। এতে মা, বাচ্চার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। সি সেকশনের সিদ্ধান্ত নেওয়াই নিরাপদ।”
তাজদার আনিসের কাছে ফোন করে রায়হানের উদ্দেশ্যেও বললো, হোক সি সেকশন, সেফটি ফার্স্ট।”
সি সেকশনের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি শুরু হলো। শাইনাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
শাহিদা বেগম আর রওশনআরা নিরবে পাশাপাশি বসে রইলেন। তিতলি ঝিমোচ্ছে। রওশনআরা তাকে ধরে রেখেছে বুকের সাথে। তৌসিফ এসে তার মাথায় চাটি মারতেই সে হকচকিয়ে উঠে গেল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,”চোর চোর!”
সবাই হতচকিত। তিতলি গোলগোল চোখ করে তৌসিফের দিকে চেয়ে রইলো। তৌসিফ কি বলবে খুঁজে পেল না।
কোমরে হাত রেখে তিতলির দিকে হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। তিতলি রওশনআরার ওড়নার নিচে মুখ লুকোলো।
সেখান থেকে উঁকি দিয়ে তৌসিফকে দেখতে লাগলো। তৌসিফ বলল,”আল্লাহ বাঁচাইছে তোকে। ভাগ্যিস এটা হাসপাতাল।”
~~~~
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে করিডোরের নিয়ন আলোতেও সবার মুখগুলো ফ্যাকাশে আর চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা প্রতিবার ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সবার হৃদস্পন্দন বাড়ছে।
শাহিদা বেগম আর রওশনআরা নিরবে পাশাপাশি বসে আছেন এখনো। শাহিদা বেগমের চোখ বন্ধ, ঠোঁট নড়ছে ফিসফিস করে, সম্ভবত দোয়া পড়ছেন।
ঝিমোনো থেকে জেগে ওঠা তিতলি এখন রওশনআরার ওড়নার নিচে লুকিয়ে চোখ গোলগোল করে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোর-চোর মন্তব্যের জন্য সে এখনও তৌসিফের সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না।
আনিস শান্ত হয়ে বসলো এক জায়গায়। তাসনুভা একপাশে দাঁড়িয়ে, এখনও তাজদারের সঙ্গে লাইনে আছে। তাজদার প্রতি মিনিটে আপডেট চাইছে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর সবার অপেক্ষা ফুরোলো।
বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে এল তীক্ষ্ণ ছন্দময় কান্নার সুর। ছোট্ট একটা প্রাণের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে তার প্রথম চিৎকার দিয়ে।
একটানা সতেজ কান্নার সুরটা অপেক্ষারত সবার কানে মিষ্টি সুরের মতো বাজছে। সেই কান্না বলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে নতুন এক আলোর আগমন হয়েছে।
অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে গেল। বাইরে অপেক্ষারত সবার শরীর একসঙ্গে সোজা হয়ে গেল। সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে।
শাহিদা বেগম, রওশনআরার চোখে মুখে আনন্দ-অশ্রুর বন্যা। তিতলি আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, “বাবু কাঁদছে! বাবু এসেছে!”
ভেতর থেকে একজন নার্স দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল। কোলের বাচ্চাটি ভীষণ হৃষ্টপুষ্ট শরীরের একটি বাচ্চা। মাথাভর্তি চুল। কাঁদছে ভীষণ।
আনিস নার্সের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। “আমার বোন…”
নার্স মিষ্টি হেসে বললেন, “চিন্তার কিছু নেই। সি-সেকশন সফল হয়েছে। মেয়েবাবু হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনেই সুস্থ আছেন।”
“মেয়েবাবু! তারমানে ভাইয়ার মতো হবে! ইয়েস!” তিতলি খুশিতে ছটফটিয়ে উঠলো। তৌসিফ হাসতে হাসতে তার মাথা চাপড়ে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিজেকে সংযত করল।
সবাই একসাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। শাহিদা বেগম এবং রওশনআরা সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। শাহিদা বেগমের চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
আনিস বাচ্চাকে কোলে নিতে নিতে মাথা নেড়ে নার্সকে ধন্যবাদ জানাল। সে মাথা নিচু করে নীরবে সদ্যোজাত বোনঝির কপালে একটা আলতো চুমু এঁকে দিল।
তৌসিফ আনন্দে শাওনের পিঠ চাপড়ে দিল।
“এসেছে তোর পকেট খালি করতে।”
শাওন বলল,”ধুর ব্যাটা পকেট এমনিতেই খালি।”
রায়হান বলল,”তাজকে ফোন দাও।”
তাসনুভা দ্রুত তাজদারের নম্বরে ফোন দিল।
খবরটি পৌঁছে যেতেই তাজদার কানখাড়া হয়ে শুনলো কান্নার শব্দটা। সদ্যজাত শিশুর সতেজ কান্নার শব্দ! তার বুক থেকে বহুক্ষণ ধরে চেপে রাখা ভারী পাথরটা সরে গেল।
সে ধীরেধীরে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। বুকের ভেতরে উষ্ণ স্রোত অনুভব হলো।
পিতা হওয়ার এই অনির্বচনীয় অনুভূতির নাম আছে কোনো? থাকলে সেটা কি?
সে কাঁপা গলায় বিড়বিড় করলো,
“আলহামদুলিল্লাহ!”
হঠাৎই জন্য তার মনে হলো এই হাজার মাইল দূরত্ব একটা বিশাল কাঁটাতার। সে বাবা হলো, অথচ মেয়ের ছোট্ট আঙুলগুলোও ধরতে পারলো না। নতুন জীবনের আগমন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী, আবার একই সাথে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ মানুষেও পরিণত করেছে। এত খুশির একটা খবর, এত আনন্দ চারপাশে কিন্তু তবুও কিছু একটা নেই নেই।
তাসনুভা বেবিকে কোলে নিতে এগিয়ে গেল। একটু বিরক্ত হয়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল,”আনিস ভাই বাবুকে এভাবে আদর করবেন না। ইটস গেটিং ঠু আনহাইজেনিক। প্লিজ মেইনটেইন এ লিটল ডিস্টেন্স। কিডস আর সুপার সেনসিটিভ। “
আনিস তার দিকে চোখ তুলে তাকালো। কপাল কুঁচকে ফেলে বলল,”বুঝিনি। কি বললে?”
তাসনুভা মুখটা গোঁজ করে তৌসিফের দিকে তাকাল । কিন্তু তৌসিফ হাসিমুখে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, এ ক্ষেত্রে সে আনিস ভাইয়ের পক্ষেই। তার হয়ে ওকালতি করতে পারবে না।
রায়হান এবার এগিয়ে এসে বলল, “আনিস, এইবার আমাদের একটু সুযোগ দাও। সবাই একটু দেখুক।”
আনিস আলতো হাতে তার বোনঝিটিকে রওশনআরার দিকে বাড়িয়ে দিল। শাহিদা বেগম আর রওশনআরা দুজনেই পরম মমতায় নতুন প্রাণটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর সবাই একসাথে হেসে বলে উঠল এই বলে,
“বাপকা বেটি। বাপের চেহারা পেলে মেয়েরা ভাগ্যবতী হয়।”
তাসনুভা খুশি হয়ে বলল,”আমার আর ভাইয়ার ফেইস সেইম সেইম।”
শাওন তার আনন্দে জল ঢেলে দিয়ে বলল,”আম্মা কপালটা পুরোটাই আব্বা মেঝ ভাই আর মণির মতো।”
শাহিদা বেগম বললেন,
“হ্যাঁ তাই তো। ওদের সবার কপাল একই। মা, মামা, নানার কপাল নিয়ে এসেছে।”
তাসনুভা সাথে সাথে কপাল কুঁচকে ফেললো। তারপর আনিসের দিকে তাকালো। আনিস তখন ফোনে কাউকে খুশির সংবাদটা দিচ্ছে। তাসনুভা বিরক্ত হয়ে বলল,
“স্টপ দিস কমপ্যারিসন থিং। হসপিটালে এসব কথা বলার কোনো মানে হয় না। নাক চোখ নিয়ে এত এনালাইসিস করে কি হবে? সুস্থ আছে এটাই বেশি।”
তিতলি কোলে নিতে চাইছে। তাসনুভা বলল, তুমি পারবে না। তিতলির কান্না পাচ্ছে।
তৌসিফ ঝটপট বেবির ছবি আর ভিডিও তুলল। তারপর সব তাজদারের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল।
তাজদার সিদ্দিকী ল্যাপটপের আলোয় আধো অন্ধকার ঘরে বসে তার সদ্যোজাত মেয়ের ছবি আর ভিডিওগুলো বারবার জুম করে করে দেখছে কৌতূহল নিয়ে ঠিক বছর দুই বছর আগে যেভাবে তার মায়ের ছবি দেখেছিল এভাবে একা বসে বসে।
বাচ্চার ছোট্ট হাতের আঙুল, ছোট্ট নাক, ছোট্ট ছোট্র পা, আর কপালের ভাঁজে ভাঁজে সে নিজের আর শাইনা মমতাজের অস্তিত্ব খুঁজছে। এই হাজার মাইলের দূরত্ব তার কাছে অভিশাপের মতো মনে হচ্ছে এইবার।
শাইনা তখনো অপারেশন থিয়েটারের পাশের পোস্ট-অপারেটিভ কেয়ার ইউনিটে। অ্যানেস্থেশিয়ার ঘোর কাটছে ধীরে ধীরে। তীব্র প্রসববেদনা আর অস্ত্রোপচারের ধকল তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে, শরীর অবসন্ন।
তবে বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা শান্তি, তৃপ্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ভারমুক্তির অভিজ্ঞতা নিয়ে শুয়ে আছে। একটা প্রাণ সঞ্চার হয়েছে তার মধ্যে থেকে। এটা কি চাট্টিখানি কথা? একবছর আগেও সে কি ছিল? কেমন ছিল?
ধীরে ধীরে চোখ খোলার পর তার প্রথম দৃষ্টি পড়ল শাহিদা বেগম আর রওশনআরার দিকে। মায়ের চোখে জল, কিন্তু সে জল শুধু জল নয়, আনন্দ অশ্রু।
শাহিদা বেগম মেয়ের কপালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন। কপালে চুমু আঁকলেন। শাইনার চোখেও জল এলো। সে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কার মতো দেখতে হয়েছে আম্মা?”
“একদম ওর বাপের মতো।”
কথাটা শুনে শাইনার ঠোঁটের কোণে সদ্য আসা হাসিটা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। চোখ দুটি স্থির হয়ে রইল ছাদের দিকে।
মনে মনে ভাবল, ন’মাস পেটে ধরেছিলাম আমি। প্রসববেদনা সহ্য করে অপারেশনের ধকল সামলালাম আমি। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। আর সবাই মিলে এক লহমায় বলে দিলো সে হয়েছে একদম বাপের মতো? এ কেমন বিচার!
সে খুশি হবে নাকি অসন্তুষ্ট নিজেই বুঝে উঠতে পারলো না।
এই অনুভূতিটা সম্ভবত সব নতুন মায়েরই হয়। দীর্ঘ পরিশ্রম শেষে পৃথিবীতে আসা সন্তানটা যখন চেহারায় তার নিজের সামান্যতম ছাপও না রেখে পুরোটা বাবার মতো হয়ে যায় তখন মিষ্টি অভিমান আসেই।
কিন্তু সেই অভিমান বেশিক্ষণ টিকল না। মেয়েকে যখন তার পাশে এনে রাখা হলো শাইনা তখন সব ভুলে গেল। ছোট, নরম, তুলতুলে হাত-পা নাড়ানো শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, সে দেখতে কার মতো হলো তাতে কী-ই বা এসে যায়? তার সবকিছুই তো ওকে ঘিরে হবে আজকের পর থেকে।
সে ক্লান্ত চোখ দুটো কোনোমতে খুলে তার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সদ্য ভূমিষ্ঠ সেই ছোট্ট শরীরটা তার পাশে নরম চাদরে মোড়ানো। ছোট্ট হাত-পাগুলো নেড়ে সে নীরবে তার মায়ের নীরব পর্যবেক্ষণকে বরণ করে নিচ্ছে।
নাক, মুখ, ঠোঁট সবকিছু নাকি তাজদার সিদ্দিকীর মতো?
কিন্তু সে কিছু বুঝতে পারছে না কেন? তাজদার সিদ্দিকীকে কখনো এত মনোযোগ দিয়ে দেখেনি বলে? দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে তার পাশে ছিল। কিন্তু কখনো এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার ঠোঁটের গড়ন, তার নাকের তীক্ষ্ণতা, এমনকি তার আঙুলগুলোর দৈর্ঘ্য দেখেনি।
তাদের সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর ছিল। কিন্তু তবুও নিবিড় মুহূর্তগুলোতেও চেহারার সূক্ষ্ম কাঠিন্য, নাকের তীক্ষ্ণতা, ঠোঁটের গড়নের মতো খুঁটিনাটি বিষয়গুলো কখনই নজরে আসেনি তার। নাকি তার আগ্রহ ছিল না বলে?
আর আজ এই রিকভারি রুম শুয়ে হাজার মাইল দূরে থাকা মানুষটার প্রতিচ্ছবি সে খুঁজে বেড়াচ্ছে এই সদ্যোজাত শিশুর মধ্যে। এই একরত্তি মেয়েটাই তাকে তার প্রতিবেশী স্বামীর অপঠিত অধ্যায় পড়তে শেখাচ্ছে। কি অদ্ভুত!
শরীরে হাত বাড়াবার শক্তি ছিল না, কিন্তু সে ফিসফিস করে ডাকলো মেয়েকে। কি বলে ডাকলো নিজেই বুঝে উঠতে পারলো না।
নার্স আলতো করে বাবুকে তার বুকের উপর দিল। নরম সেই ছোট্ট শরীরটার হালকা ওজন শাইনার ক্লান্ত শরীরে অপার্থিব শান্তি এনে দিল।
তার মুখের সাথে ছোট্ট গালটা ঠেকে রইলো চুপচাপ। সদ্যোজাতর চামড়ার মিষ্টি গন্ধটা তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে শান্ত করে দিল মুহূর্তেই। এত শান্তি, শক্তি কতদিন সে খুঁজে পায়নি নিজের মধ্যে।
শাইনা চোখ বুজে ছিল। হঠাৎ তার চোখের সামনে আলো এসে পড়লো। তিতলি ফোন নিয়ে এসেছে। সে অতি সাবধানে শাইনার মুখের সামনে রাখলো। ভিডিও কলে তাজদার সিদ্দিকী!
তিতলি উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, “নাও কথা বলো “
শাইনা সরাসরি স্ক্রিনের দিকে তাকালো না। না তাকিয়েও চোখের কোণের একচিলতে দৃষ্টিতে দেখতে পেল তাজদার সিদ্দিকী মনোযোগ দিয়ে তাকে আর বাবুকে দেখে যাচ্ছে পলকও না ফেলে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে তাকে এভাবে দেখে।
মেয়ে হুবহু তার মতো দেখতে হয়েছে বলে তাজদার সিদ্দিকীর ঠোঁটের কোণায় যে গর্বিত হাসি ঝুলছে, তা শাইনা দেখতে চায় না বলেই তাকালো না সরাসরি।
তাদের দুজনের মধ্যে হওয়া সেই শিশুসুলভ বাজিটা তাজদার সিদ্দিকী জিতে গেছে এই মুহূর্তে সে তা প্রকাশ করতে নারাজ।
তাজদার সিদ্দিকী বড় মগে কফি নিয়ে বসেছে। চুল এলোমেলো, নির্ঘুম রাতের চিহ্ন চোখের নিচে তারপরও ঠোঁটের হাসিটা লুকোনোর অপচেষ্টা করছে কফির মগে চুমুক দিয়ে। ঠোঁটের সামনে থেকে কফির মগ সরিয়ে ক্যামেরার সামনে একটু ঝুঁকে এসে চুল আর শার্টের বোতাম ঠিক করতে করতে বলল,
“হাই!”
শাইনা এবার ধীরেধীরে তাকালো সরাসরি। তাজদার সিদ্দিকী আবারও কফির মগে চুমুক দিল। শাইনার চেহারা দেখে তার হাসি চেপে রাখা দায়! সে গর্ব করে বলল,
“কংগ্রাচুলেশন অন অফিশিয়ালি বিকামিং দ্য বেবি মাম্মা অব তাজদার সিদ্দিকী’স বিউটিফুল ডটার। ওহ ইয়েস, প্রডাকশন কোয়ালিটি ইজ টপ-নচ, রিয়ালি ইমপ্রেসিভ!”
শাইনা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। তাজদার সিদ্দিকী সাথে মেয়ের মুখের খুঁটিনাটি মিলানোর চেষ্টা করছে সে। এই মুখ সে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না।
তাজদার কপালটা একটুখানি কুঁচকে বলল,”নজরটিকা লাগিয়ে আসা উচিত ছিল?”
চলমান…
Share On:
TAGS: তাজমহল সিজন ২, প্রিমা ফারনাজ চৌধুরী
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১০
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১২+১৩
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ২
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৭+৮
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৭+১৮
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৫+১৬
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৪
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ৬
-
তাজমহল সিজন ২ পর্ব ১৪