#তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
#ফারহানা_কবীর_মানাল
২.
বাড়ির সামনের খানিকটা জায়গায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদা জমেছে। দেখেশুনে পা উঁচু করে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে হয়। বের হওয়ার সময়ও সেই সাবধানতা অবলম্বন করেছিলাম। এখন পারলাম না৷ কাঁদা মাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে আলো জ্বলছে না। চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ নেই। ছোট আপা সোফায় বসে আছে। সে আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ব্যস্ত গলায় বললাম, “কী হয়েছে? কী সমস্যা হয়েছে?”
“দুঃস্বপ্ন দেখেছি।”
ভীষণ বিরক্ত লাগল। বিরক্ত গলায় বললাম, “এটা খুব বড় সমস্যা?”
“তোর জন্য বড় সমস্যা না। কারণ স্বপ্নটা তুই দেখিসনি। আমি দেখেছি। আমার জন্য বড় সমস্যা।”
“কী স্বপ্ন দেখেছ?”
“দুঃস্বপ্নের কথা কাউকে বলতে হয় না। রাত-বিরেতে ঘরের বাইরে যাবি না।”
“আপা আমি ছোট বাচ্চা না। যথেষ্ট বড় হয়েছি। তুমি এমনভাবে কথা বলছিল প্রাণ উড়ে গিয়েছিল।”
“এত রাতে কোথায় গিয়েছিলি? প্রেমিকা টেমিকা আছে নাকি?”
“না নেই।”
“তাহলে?”
কথার জবাব দিলাম না। আপার কথার ধরন আমার ভালো লাগেনি। এমনভাবে বলেছিল যেন বাড়িতে কী না কী হয়ে গেছে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এটা আর এমন কী বড় ব্যাপার। অনুরিমা নামের মেয়েটার খোঁজ নেওয়া হলো না। এখন আর বের হতে পারব না। আপা দাঁড়িয়ে আছে। না শোয়া পর্যন্ত এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে। এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ফোন চার্জে বসাতে হবে। ইচ্ছে করছে না। কেমন একটা ক্লান্তি শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে।
সচারাচর খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস আমার নেই। তবে ফজরের নামাজ পড়ি। নামাজ পড়ি ঘুমের ঘোরে। নামাজে কোন কোন সূরা পড়ি পরবর্তীতে আর মনে থাকে না। আজ খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেছে। অতো রাতে শোবার পরেও শরীরের ভেতরে কোন ক্লান্তি নেই৷ ঝরঝরে লাগছে। বাড়ির পরিবেশ শান্ত। মা নামাজ শেষ করে কুরআন শরিফ নিয়ে বসছেন। সুর করে সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করছেন। মুখ হাত ধুয়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। মা সূরা শেষ করে মাথায় ফু দিয়ে দিলেন। বিড়বিড় করে কিসব দোয়া কালাম পড়লেন। কোমল গলায় বললেন, “আল্লাহ আমার বাচ্চাদের ভালো রাখো। ওদের কোন বিপদ দিও না।”
“মা!”
“হুম, বল।”
“ছোট আপা কয়েকটা দিন আমাদের বাড়িতে থাকুক। আপার কাছে কিছু জিজ্ঞেস করো না।”
“মিনু তোকে কিছু বলেছে?”
“আপা কিছু বলেনি। তুহিন ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিলাম।”
“তুহিন কী বলল? ঝগড়া করে এসেছে?”
“না। ঝগড়া ঝামেলা হয়নি। এমনি একটু মনমালিন্য হয়েছে। তুহিন ভাইয়ের অফিসে ঝামেলা হচ্ছে, সে ওইসব ঝামেলায় ব্যস্ত হয়ে আছে। এই নিয়ে আপা একটু রাগারাগি করেছে। তুহিন ভাই বলছে– দু’চার দিন পর এসে আপাকে নিয়ে যাবে।”
“শোকর আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে।”
মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মায়ের চোখ-মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। যেন খুব ভালো কোন সংবাদ শুনেছেন। মন খুশি করে দেওয়ার মতো ভালো।
সকালের নাস্তার সময় হয়ে গেছে। মা উঁচু গলায় সবাইকে খেতে ডাকছে। আয়োজন ভালো। চিংড়ি পোলাও, সাথে দেশি মুরগির রোস্ট। মায়ের পোষা মুরগি। খুব আনন্দের কিছু ঘটলে মা এই মুরগি জ’বা’ই করেন। সেদিন বাড়ির সবার আনন্দের সীমা থাকে না।
বাড়ির পরিবেশ শান্ত এবং স্বাভাবিক। ছোট আপা জারিফকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। জারিফ খেতে চাইছে না। মুখ বন্ধ করে রেখেছে।
পোলাওয়ের গন্ধে ঘর ম-ম করছে। ভাইয়া ভাবী দু’জনে খেতে বসেছে। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। ভাইয়া আমাকে দেখে মুচকি হাসল। স্বাভাবিক গলায় বলল, “দাঁড়িয়ে না থেকে খেতে বসে যা। মা মুরগি জ’বা’ই করেছে। কোন খুশিতে করেছে জানি না, তবে রান্নার স্বাদ খুব ভালো। দেরি করিস না।”
অল্প হেসে খেতে বসলাম। মা প্লেটে পোলাও মাংস তুলে দিতে দিতে বললেন, “নজু, খাওয়া শেষ করে একটু বাজারের দিকে যাবি। কয়েকটা জিনিস কিনতে হবে।”
“আচ্ছা যাব।”
“জারিফ নুডলস খেতে পছন্দ করে। ওর জন্য কয়েক প্যাকেট নুডলস নিয়ে আসবি। মিস্টার নুডলস আনবি। ও ওইটা ভালো খায়।”
“আনব।”
“যাওয়ার আগে মিনুর সাথে কথা যাস। যদি কিছু আনতে বলে।”
“যাব।”
মা ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছেন। মায়ের কথায় মন লাগাতে পারছি না। রাতের ব্যাপারটা এখনও মাথার মধ্যে ঘুরছে। সকালে বেশ কয়েকবার ওই নম্বরে কল দিয়েছি। সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অল্প বয়সী মেয়েরা মজা করার জন্য রাতদুপুরে অচেনা নম্বরে কল দেয়। ভুলভাল কথাবার্তা বলে ঠোঁট টিপে হাসে। এই কলটা তেমন হওয়ার সুযোগ নেই। ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। তবে অন্যভাবে!
খাওয়া শেষ করে বাড়ি থেকে বের হলাম। হাতে বাজারের থলে। বাজার করার জন্য দুই হাজার টাকা দিয়েছে। খাওয়া শেষ হতেই ভাবী ডেকে পাঠালো। লম্বা কাগজের লেখা ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “সবকিছু দেখেশুনে নিয়ে আসবে। ভুল করবে না। মুদি দোকান থেকে জিনিস কেনার সময় ডেট চেক করে নিবে। কিছু দোকানদার খুব ফাজিল। মেয়াদ উত্তির্ন জিনিসপত্র বিক্রি করে দেয়।”
“আচ্ছা আনব।”
“দু’শ টাকা নিজের পকেটে রাখবে। সব টাকা দিয়ে বাজার করবে না।”
“ঠিক আছে রাখব।”
ভাবী মানুষ ভালো। ভালো মানুষদের কথা শোনা উচিত। কিন্তু আমি শুনব না। আপাতত বাজারের দিকে যাওয়ার সময় নেই। অনুরিমা নামের মেয়েটার খোঁজ করতে হবে। গতরাতের কথাগুলোর মানে জানা খুব জরুরি। তুহিন ভাইয়ের সাথেও কথা বলতে হবে।
তুহিন ভাইদের অফিসটা বেশ বড়। পাঁচ তলা বিল্ডিং। নিচে বিশাল এয়িরা নিয়ে ক্যান্টিং আছে। ফুলের বাগান আছে। অফিসের মালিক বেশ সৌখিন। প্রতিদিন এগারোটা পঁচিশে অফিসে ঢোকেন। আজকেও ঢুকলেন। একটু জন্য গাড়ির সাথে ধা’ক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে গেলাম। ভদ্রলোক নিজে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। গায়ে হাত রেখে বললেন, “আপনি ঠিক আছেন? অনেক দুঃখিত! আমি ঠিক খেয়াল করতে পারিনি।”
“সমস্যা নেই। আমি ঠিক আছি।”
“আপনি ঠিক নেই। কপালের বা দিকটা কে’টে গিয়েছে। র’ক্ত পড়ছে।”
“সামান্য একটু লেগেছে। এতে কিছু হবে না।”
“সামান্য চোট না। অনেকখানি কে’টে গিয়েছে। আপনি আমার সাথে আসুন। অফিসে ফাস্টএইড বক্স আছে। ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেব।”
“প্রয়োজন নেই।”
ভদ্রলোক আমার নিষেধ শুনলেন না। হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। নিজের কেবিনে বসতে দিয়ে বললেন, “কেউ আমার দ্বারা আ’ঘা’ত পেলে আমার খুব খারাপ লাগে। সেবা যত্ন করতে না পারলে শান্তি পাই না।”
“আচ্ছা।”
তিনি বেল বাজালেন। অল্প বয়সী একটা মেয়ে ফাস্টএইড বক্স হাতে ভেতরে ঢুকল। মিষ্টি গলায় বলল, “স্যার, আমাকে ডেকেছেন?”
“ডেকেছি। এই ভদ্রলোকের কপাল কে’টে গিয়েছে। র’ক্ত পরিষ্কার ব্যান্ডেজ করে দাও।”
মেয়েটি খুব যত্নসহকারে র’ক্ত পরিষ্কার করল। ওষুধপত্র লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। বাড়তি কথাবার্তা বলল না।
ভদ্রলোক বললেন, “ধন্যবাদ রূপসী। তুমি এখন যেতে পারো।”
বলেই হাসলেন। মেয়েটি চলে গেল। তিনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “শরিফুল। শরিফুল হাসান।”
অল্প হেসে হাত মেললাম।
“নজরুল হোসেন। ডাকনাম নজু।”
“বেশ ভালো নাম। পড়াশোনা কতদূর?”
“মাস্টার্স শেষ করেছি।”
“চাকরি করেন?”
“না, চাকরিবাকরি শুরু করিনি। আপাতত বেকার ঘুরছি।”
“আমার অফিসে জয়েন করতে বললে রাজি হবেন?”
বিস্মিত চেহারা নিয়ে শরিফুল সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোক বোধহয় আমার মনের কথা পড়তে পারলেন। অন্যরকম গলায় বললেন, “এতে এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। ফ্রি-তে কিছু করছি না। আপনি কাজ করবেন, বিনিময়ে টাকা নিবেন। আদানপ্রদানের ব্যাপার। আমার অফিসের লোকবল ভালো না। বেশ কয়েকজন কর্মচারী ছাঁটাই করা হবে। পোস্ট খালি হয়ে যাচ্ছে। নতুন লোকের প্রয়োজন।”
“কর্মচারীদের ছাঁটাই হচ্ছে কেন?”
“কাজের জায়গা খুব পবিত্র। এখানে অ’শ্লী’ল কোন কিছু আমি সহ্য করব না।”
“আচ্ছা।”
“রাজি থাকলে নিজের সিভি নিয়ে আসুন। সার্টিফিকেটের আসল কপি নিয়ে আসবেন। চার কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি আনবেন, স্টাম সাইজের দু’টো। দেরি করবেন না।”
“ঠিক আছে।”
“আজকের মধ্যে আসুন। দুপুর তিনটে পর্যন্ত অফিসে থাকব। এর মধ্যে আসবেন।”
“আচ্ছা আসব।”
শরিফুল সাহেবকে লম্বা সালাম দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। কপাল ফা’ট’লে দূর্ভাগ্য আসে– এই কথাটা সত্যি না। কপাল ফা’টি’য়ে আমার চাকরি জুটে গেছে। এত বড় অফিসে হুট করে চাকরি পাওয়াটা বাস্তবসম্মত নয়। বাস্তবে এমন হয় না। গল্প উপন্যাসে হতে পারে। স্বপ্ন দেখছি নাকি? স্বপ্নও হতে পারে। ভোররাতের খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার পরেও অনেকক্ষণ যে স্বপ্নের রেশ থেকে যায়। নিজের গা’য়ে একটা চিমটি কা’ট’লা’ম। ব্যাথা পাচ্ছি। অর্থাৎ এটা স্বপ্ন নয়।
হাত খালি দেখে মা ভীষণ চটে গেলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “সদাই-পাতি কোথায়?”
“সময় পাইনি।”
“সময় পাসনি মানে? কী এমন রাজকার্য করছিলি যে সামান্য কয়েকটা জিনিস কেনার সময় পাসনি?”
“চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম।”
“কোন চাকরি? মজা করছিস আমার সাথে?”
“না মা, মজা করছি না। সত্যি বলছি। রাস্তায় এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা হলো। ভদ্রলোক উনার অফিসে ডেকে নিয়ে গেলেন। এসি ঘরে বসিয়ে চাকরির অফার করলেন। সিভি নিতে এসেছি। সার্টিফিকেট নিতে হবে। ছবি তুলতে হবে।”
মা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলেন।
আমাদের ভাইবোনের সব ধরনের কাগজপত্র মায়ের কাছে থাকে। সবার এনআইডি কার্ড পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকে। আমার কিছু মায়ের কাছে নেই। ইন্টারভিউতে লাগবে বলে নিজের ঘরে এনে রেখেছি। পুরোনো কাঠের বাক্সে অমন দামী কাগজ রাখতে ভরসা হয় না। আমিও যে খুব যত্নআত্তি করে রেখেছি, তেমন না। ফাইলে ঢুকিয়ে বিছানায় নিচে রেখে দিয়েছি। তোশক উল্টে ফাইলগুলো বের করলাম। ঠিক সেই সময়ে মা ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “টাকা ফেরত দে।”
পকেট থেকে টাকা বের করে মায়ের হাতে দিলাম। পরনের কাপড় বদলে ফর্মাল পোশাক পরে নিলাম। মা ভীষণ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। অদ্ভুত গলায় বললেন, “সত্যি সত্যি চাকরি পেয়েছিস?”
“নব্বই শতাংশ পেয়েছি। কাগজপত্র দেখানোর পরে বাকি দশ শতাংশ নিশ্চিত হতে পারব।”
“কাজ কিসের?”
“জানি না। কাজকারবারের কথা বলতে পারি না।”
ফট করে মায়ের হাত ধরে ফেললাম।
“আমার জন্য দোয়া করো মা। চাকরিটা যেন পেয়ে যাই।”
এতক্ষণে এই প্রথম মা আমার কপালের ব্যান্ডেজটা খেয়াল করলেন। ব্যস্ত গলায় বললেন, “তোর কপালে কী হয়েছে?”
“ভাগ্য খুলে গিয়েছে।”
মা আমার কথা বুঝলেন না। আমিও তাকে বুঝিয়ে বলার সময় পেলাম না। অনেক কাজ বাকি। স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলতে হবে। ঘরে যেসব ছবি তোলা ছিল সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।
দু’টো বাজতে দুই মিনিট বাকি। ওয়েটিং রুমে বসে আছি। শরিফুল সাহেব জরুরি মিটিং করছেন। আমাকে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। মাঝবয়েসী একজন লোক এসে এক কাপ চা দিয়ে গিয়েছে। চমৎকার চা। আদা দেওয়া। মিনিট বিশেক অপেক্ষা করার পর আমার ডাক পড়ল। শরিফুল সাহেব লজ্জিত গলায় বললেন, “মিটিং করছিলাম।”
কী আশ্চর্য! অফিসের বস আমাকে অপেক্ষা করার জন্য লজ্জিত বোধ করছেন। হঠাৎই মনে হলো বস পদের সাথে এই লোকটার ভাবসাব যাচ্ছে না। এত বড় এসি রুমে বসে সাধারণ চাকরি প্রার্থীর সাথে এমন বিনয় মেনে নেওয়া যায় না।
“কী ভাবছেন?”
“জ্বি! কিছু ভাবছি না।”
“এত ভাবনার কিছু নেই। কাগজপত্র দেখান।”
“বাহ! আপনার রেজাল্ট তো খুব ভালো। অনার্সের সিজিপিএ তিন দশমিক আটানব্বই। এই রেজাল্ট নিয়ে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?”
অল্প হাসলাম। আজকালকার দিনে রেজাল্ট কোন বড় বিষয় না। টাকাই সব। টাকা থাকলে দুই দশমিক শূন্য রেজাল্ট নিয়েও বড় পদে চাকরি করা যায়। শরিফুল সাহেব বললেন, “আজকে থেকেই জয়েন করে ফেলুন। অফিসের টাইম যেটুকু বাকি আছে কাজকর্ম বুঝে যান। বেতন নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপাতত ত্রিশ পঁয়ত্রিশ। আস্তে আস্তে পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে যাবে। এই ব্যাপারটা ঠিক করা হবে আপনার পারফরম্যান্স বিচার করে।”
“জ্বি আচ্ছা। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
“কম্পিউটার চালাতে পারেন? না পারলেও সমস্যা নেই। শিখিয়ে নেওয়া হবে।”
“জ্বি আচ্ছা।”
“আলাদা একটা ঘর পাবেন। সবার সাথে বসে কাজ করতে হবে না। মঞ্জুর সব বুঝিয়ে দেবে।”
মাথা দোলালাম। চোখে পানি এসে যাচ্ছে। পকেটে টাকা নেই। সব টাকা মা’কে দিয়ে এসেছি। টাকা থাকলে বাড়িতে ফেরার সময় মিষ্টি কিনে নিয়ে ফিরতাম। আমার চাকরির খবরে কে বেশি খুশি হবে? মা, ছোট আপা, ভাইয়া নাকি ভাবি? আলাদা করা বলা খুব মুশকিল। সকলেই আমায় খুব ভালোবাসে।
সিঁড়িতে তুহিন ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। সে ফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। ধা’ক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে গেছি। তুহিন ভাই আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল, “তুমহ এখানে?”
পাশ থেকে মঞ্জুর নামে লোকটা একগাল হেঁসে বলল, “স্যার, আমাদের অফিসে নতুন জয়েন করেছে। বড় স্যারের রুম থেকে মাত্র বের হলো। স্যারকে আপনি চেনেন?”
তুহিন ভাই বলল, “নজু, এসব কী শুনছি? এই অফিসে তোমার চাকরি হয়েছে?”
“জ্বি ভাই হয়েছে।”
“এতো খুব ভালো সংবাদ। চলো এই উপলক্ষে তোমাকে একটা ট্রিট দিই। আজ আমি দেব। বেতন পাওয়ার পর তুমি আমাকে দেবে।”
“আচ্ছা।”
“ক্যান্টিনের দিকে চলো। পাবদা মাছের ঝোলটা বেশ দারুণ।”
“আচ্ছা।”
“আচ্ছা আচ্ছা করছ কেন? এত ভালো চাকরি পেয়েছ। মন ভালো নেই?”
“আছে।”
তুহিন ভাই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। বাঁকা চোখে আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল। সে কথা বলছে সত্যি, তবে তার মন ফোনের দিকে। বারবার করে ফোন দেখছে।
ক্যান্টিনের শেষ টেবিলটায় অনুরিমা বসে আছে। সে আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। উঠে চলে যেতে গিয়েও যেতে পারল না। শান্ত ভঙ্গিতে তার সামনে বসলাম। একগাল হেঁসে বললাম, “মিস অনুরিমা, আজ থেকে আমিও আপনাদের কলিগ। আমার সাথে বসে খেতে পারেন। আজকেই জয়েন করেছি।”
“অভিনন্দন!”
“এই নম্বরটা চিনতে পারেন?”
অনুরিমা কপাল কুঁচকে ফোনের দিকে তাকাল। মাথা দুলিয়ে বলল, “না, চিনতে পারছি না।”
“কাল রাতে এই নম্বর থেকে কেউ একজন আমাকে কল দিয়েছিল। সে আপনার নাম বলেছে।”
“অনুরিমা নামের অনেক মেয়ে থাকতে পারে। এটা তো আমার একার নাম না।”
“তা থাকতে পারে। আপনার নম্বরটা দেন।”
“জ্বি, আমার নম্বর মানে?”
“আহা! আজ থেকে আমরা কলিগ। কলিগ কলিগের নম্বর রাখতে পারে না?”
“নিশ্চয়ই পারে।”
“তাহলে আপনার ফোন বের করুন। আপনার নম্বর থেকে আমাকে একটা কল দেন।”
অনুরিমা ফোন বের করল। ফট করেই ওর কল রিসিভ করে বসলাম। অনুরিমা বলল, “কল রিসিভ করলেন যে?”
“ভুল করে রিসিভ করে ফেলেছি। দুঃখিত।”
সে একটু হাসার চেষ্টা করল। রাতের মেয়েটার সাথে অনুরিমার ফোন নম্বরের মিল নেই। কণ্ঠের মিল আছে। খানিকটা ভিন্ন শোনালেও কণ্ঠস্বর আলাদা না। এমনিতে তার অবস্থা দেখার মতো। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। বাতাসের অভাব নেই। কিন্তু সে ঘেমে গেছে। স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেও স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। তুহিন ভাই খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে আছে। ফোনে কিসব কাজ করছে।
“তুহিন ভাই, ছোট আপা আপনাকে যেতে বলেছে।”
তুহিন ভাই চমকে আমার দিকে তাকাল।
“সত্যি যেতে বলেছে?”
“না মানে ঠিক যেতে বলেনি। আপনাকে নিয়ে চিন্তা করছিল।”
“ওহ আচ্ছা! ওকে বলবে আমি ঠিক আছি। চিন্তা না করতে। রাতে ঠিকমতো খেয়ে ঘুমাতপ বলবে। মাথার কাছে কাঁথা ভাজ করে রাখতে বলবে। রাতে ঠান্ডা পড়ে।”
তুহিন ভাই এক নাগাড়ে কথাগুলো বলল। অনুরিমার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। যেন সে খুব বিরক্ত।
অফিস ছুটি হলো চারটের দিকে। কাজকর্ম বুঝে নিয়েছি। তেমন বিশেষ কোন কাজ না। ফাইলপত্রে ভুল আছে কি-না দেখে দিতে হবে। একবার চোখ বুলিয়ে নিলেই হয়ে যাবে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। যে কোন সময়ে বৃষ্টি শুরু হবে। পকেটে টাকা নেই। হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা প্রবল। রূপসী নামের মেয়েটা রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে বোধহয়। এই মেয়েটা তখন আমার অনেক সেবা করেছে। ধন্যবাদ জানানো হয়নি। ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। কপালের দিকে ইশারা করে বললাম, “এটা জন্য ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এটাই আমার কাজ।”
“তবুও বললাম। বাড়ি ফিরবেন?”
রূপসী আমার দিকে তাকাল। ওর তাকানো দেখে মনে হলো খুব বোকা বোকা প্রশ্ন করে ফেলেছি।
“জ্বি, বাড়িতে ফিরব। আপনিও কী বাড়িতে ফিরবেন?”
“ফিরতে হবে। কিন্তু কী করব বুঝতে পারছি না। আকাশের অবস্থা ভালো না।”
“রিকশা ধরে চলে যান।”
“টাকা নেই। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি।”
রূপসী ব্যাগ থেকে দু’শ টাকার একটা নোট বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিলো। সহজ গলায় বলল, “ধার দিলাম। কালকে অফিসে এসে শোধ করে দিবেন।”
লোকের কাছে হাত পেতে টাকা নিতে আমার ভালো লাগে না। খুব ঘনিষ্ঠ কেউ না হলে তাদের দেওয়া টাকা ধরি না। রূপসীর টাকা ধরলাম। মেয়েটা অল্প হাসল।
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে পারি।”
“প্রশ্ন করতে পারেন। কিন্তু কিছু মনে করব কি-না সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। মনে করার মত প্রশ্ন হলে নিশ্চয়ই মনে করব।”
“অফিসের হালচাল কেমন?”
“ভালো।”
“শুধু ভালো?”
“হুম।”
“তুহিন ভাই, অনুরিমা এরা কেমন?”
রূপসীর মুখের ধরন বদলে গেল। সে একটু ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল, “কাল কথা বলব। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলেই হাঁটতে শুরু করল।
বাড়িতে খুশির সীমা নেই। মা আবারও একটা মুরগি জ’বা’ই করেছেন। রাতে সরু চালের সাদা ভাতের সাথে ঝাল ঝাল মুরগির মাংস। ছোট আপা খুশিতে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। ভাইয়ার হাসি থামছে না। সামান্য একটা চাকরি পেয়েছি। এত খুশির কী আছে?
সন্ধ্যার নামার পরপরই বড় আপা এলো। ছোট মেয়েকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। বড় আপা অসম্ভব স’ন্দে’হপরায়ণ, ঝ’গ’ড়া’টে এবং ছিচকাদুনে। আমার চাকরির খবর শুনেই কাঁদতে শুরু করল। তীক্ষ্ণ এবং তেঁতো গলায় ঝগড়া করতে করতে বলল, “আমি তোর পর তাই না রে নজু? এত ভালো চাকরি পেলি অথচ আমাকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করলি না। কেন রে? আমি শুনতে কী হতো? আমি তোর বেতনের সব টাকা নিয়ে যেতাম?”
মা অনেক বলেও আপাকে কিছু বোঝাতে পারলেন না। বড় আপা ক্রমাগত কাঁদল। রাতে কিছু খেলো না। না খেয়ে ঘুমতে গেল। তনিমা তার মায়ের কান্ডকারখানা দেখে বলল, “সিরিয়াল দেখে দেখে মায়ের মাথা গেছে। তোমরা চিন্তা করো না। ভাত তরকারি গুছিয়ে রাখো। খিদে পেলে রাতে উঠে খেয়ে নেবে।”
মা তনিমার কথায় বিস্তার হাসলেন। ভাবীও হাসল। ভাইয়া বলল, “অনেক হয়েছে। এবার সবাই শুয়ে পড়। নজু তুইও গিয়ে শুয়ে পড়। নতুন অফিসে দেরি করে যাওয়া উচিত হবে না।”
ভাইয়ার কথা মেনে তাড়াতাড়ি করে শুয়ে পড়লাম। ফোনে এলার্ম দিয়ে রেখেছি। অবশ্য এলার্মের কোন দরকার পড়বে না। মা ডেকে দেবে।
ঘুম ভাঙল মাঝে রাতে। ফোনে ক্রিংক্রিং শব্দ হচ্ছে। ভুল সময়ে এলার্ম দিয়ে ফেলেছি ভেবে ফোনটা হাতে নিলাম। গত রাতের সেই অচেনা নম্বর থেকে কল আসছে। কল রিসিভ করে ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরলাম। ওপাশ থেকে কেউ খুব শান্ত গলায় বলল, “চাকরিতে ঢুকেছ ভালো কথা। কৌতূহল নিয়ন্ত্রণ করে চলবে। না হলে সামনে খুব বি’প’দ।”
কল কে’টে গেল। সাথে সাথে কল ব্যাক করলাম। ফোন বন্ধ। ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। মেঝেতে খুব চমৎকার নকশা তৈরি হয়েছে। ভালো লাগছে দেখতে।
চলবে
Share On:
TAGS: তখনও সন্ধ্যা নামেনি, ফারহানা কবীর মানাল
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE