bhooter golpo

অভিশপ্ত ট্রেন


অভিশপ্ত ট্রেন
লেখক : নুর

খয়রাত নগর স্টেশন, এক ধূসর জনপদ। নীলফামারী জেলার মফস্বল এলাকার এই রেল স্টেশনটি যেন কালের সাক্ষী। স্টেশন মাস্টারের ঘরটি পরিত্যক্ত, প্ল্যাটফর্মের গা থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ইলেকট্রিসিটির কোনো বালাই নেই। পশ্চিম দিকে যে ছোট বাজারটি আছে, সেখানে কেবল কিছু চায়ের ও আনাজের দোকান। দুর্বল সোলার প্যানেলের আলোয় সেগুলো টিমটিম করে জ্বলে। ক্যাসেট প্লেয়ারে ভাসা ভাসা গান বাজে।

সন্ধ্যা নামার পর থেকেই বাজারটা প্রাণহীন। এখন রাত প্রায় দেড়টা। হাড় কাঁপানো শীত আর ঘন কুয়াশা চাদরের মতো ঘিরে রেখেছে সবকিছু। এই হিমশীতল রাতে ভাঙা প্ল্যাটফর্মে আমরা পাঁচজন বসে আছি। নীরবতা এমনভাবে জমাট বেঁধেছে যে, নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দও কানে লাগছে।
বাস ধর্মঘটের কারণে সন্ধ্যার পর থেকে আমরা লোকাল ট্রেনের অপেক্ষায় আছি। গোয়ালন্দঘাট নামে যে ট্রেনটির রাত দশটায় আসার কথা ছিল, তার কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বাচাল ছেলেটি, শাহেদ, সেও ট্রেনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে এখন চুপ। কেবল একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। এই গভীর রাতে, এক নির্জন স্টেশনে বসে পাঁচ তরুণ কেবলই আঁধারের গভীরতা মাপছি। সোহেলের কথা শুনলে অবশ্য এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। সে বলেছিল পায়ে হেঁটে অন্তত সৈয়দপুর পর্যন্ত চলে যেতে। কিন্তু অলস রিফাতের কথায় কান দিয়ে আমরা থেকে গেলাম। নিজেদের ওপরই রাগ হচ্ছে।

এরই মধ্যে জুয়েলের মুখে একটা গল্প শুনে সবাই চুপসে গেছে। গা ছমছম করা এক গল্প। এই রেলপথে নাকি মাঝে মাঝে একটা অভিশপ্ত ট্রেন চলে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দপুরের হিন্দু মাড়োয়ারী পরিবারগুলোকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পাকিস্তানি সেনারা একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে। তাদের কথায় বিশ্বাস করে শত শত পরিবার সেই ট্রেনে চেপে বসেছিল। ট্রেনটি সৈয়দপুর থেকে ছেড়ে খয়রাত নগর-সৈয়দপুরের মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছালে হঠাৎ থেমে যায়। তারপর সব যাত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। গুলি, ব্রাশফায়ার, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে সবাই খুন হওয়ার পর তাদের মালামাল আর গয়না লুট করে নেয় তারা। সেই থেকে নাকি এই লাইনে মাঝে মাঝে সেই ভৌতিক ট্রেনের দেখা মেলে।জুয়েল এই গল্পটা তার দাদুর কাছে ঢাকায় শুনেছিল। দাদুর এক বন্ধু নাকি তখন সৈয়দপুর রেল কারখানায় কাজ করত।

ট্রেনের কোনো চিহ্নই নেই। স্টেশন মাস্টার থাকলে হয়তো একটু সাহস পাওয়া যেত। পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন জানান দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, কেন যে এই সফরে এসেছিলাম! অবশ্য একেবারে উদ্দেশ্যহীন ছিল না আমাদের এই ভ্রমণ। আমরা সবাই টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। এখানকার টেক্সটাইল মিলগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্যই আসা। এই মফস্বল এলাকার মিলটি বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ ছিল—এর আশেপাশে তিস্তার বিশাল কৃত্রিম সেচ খাল। সেই খাল দিয়ে স্বচ্ছ টলটলে পানি বয়ে চলে। সামনে কোনো নদী পড়লে, তার ওপর দিয়ে সাইফন দিয়ে প্রবল বেগে পানির স্রোত ছুটে যায়—এই রোমাঞ্চকর দৃশ্য দেখার জন্যই উত্তরবঙ্গের এই এলাকা ভ্রমণ। রাত যত গভীর হচ্ছে, শীত তত বাড়ছে। শাহেদ আর রিফাতের খুনসুটিও চলছে। জুয়েলের ঘড়িতে রাত দুটো বাজছে। ভাগ্যিস সে ঘড়িটা সঙ্গে এনেছিল, নয়তো এই মোবাইল-নির্ভর যুগে সময় জানার উপায় ছিল না। আমাদের কারো ফোনেই চার্জ নেই। হঠাৎ করেই রিফাত আর সোহেল একসঙ্গে চিৎকার করে ওঠে, “ট্রেন আসছে!”

দূর থেকে ট্রেনের ইঞ্জিনের ক্ষীণ আলো দেখা যায়। কুয়াশার ভেতর দিয়ে সেই আলো ধীরে ধীরে কাছে আসে। এই নিকষ কালো আঁধারেও সবার মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস স্পষ্ট। ট্রেন থামার আগেই আমরা হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ি। বগির ভেতর বিন্দুমাত্র আলো নেই, লোকাল ট্রেনের কমন বৈশিষ্ট্য। অন্ধকারে কারো মুখ দেখা যায় না। সিটগুলো অস্বাভাবিক নরম, যেন গদি পাতা। গার্ড মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে, কারণ হুইসেল ছাড়াই ট্রেন চলতে শুরু করে। কামরায় আমরা পাঁচজন ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। আলো না থাকলেও বগিগুলো অন্য লোকাল ট্রেনের চেয়ে অনেক উন্নত। এমনকি জামালপুর কমিউটার ট্রেনের চেয়েও শতগুণ ভালো। কেমন যেন একটা মিষ্টি সুগন্ধ আসছে ভেতর থেকে। রিফাত তার ঢাকার পরিকল্পনা নিয়ে বলতে শুরু করে, ‘কী করবে, কোথায় যাবে’—আরও কত কী!

ট্রেন খুবই ধীরগতিতে চলতে শুরু করে। শাহেদ তার ব্যাগ থেকে দু’দিন আগের স্যান্ডউইচ আর পানির বোতল বের করে খেতে শুরু করে। এইবার নাকে একটা উৎকট, পচা গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। মনে হলো যেন কোনো পুরোনো, অব্যবহৃত লাশঘরের পচা আবর্জনা বাতাসে মিশে গেছে। গন্ধটা এত তীব্র যে গা গুলিয়ে উঠল। হঠাৎ শাহেদ একটা তীব্র, গোঙানির মতো শব্দ করে। তার হাত থেকে পানির বোতল ছিটকে আমার গায়ে এসে পড়ে। কাঁচের বোতল নয়, বরং ধাতব কিছু যেন। বোতলটা আমার গায়ে পড়ে গড়িয়ে যেতেই একটা অদ্ভুত ভেজা, পিচ্ছিল অনুভূতি পেলাম। অন্ধকারের মধ্যেই যেন এক গাঢ়, কালো রক্তের ধারা আমার হাত বেয়ে নেমে গেল। শাহেদ তার ডান হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। তার আঙুলগুলো কাঁপছে থরথর করে। সে কিছুই বলতে পারছে না, কেবল গোঙাচ্ছে আর আঙুল দিয়ে সামনের দিকে দেখাচ্ছে। তার চোখগুলো যেন কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
আমি তার দেখানো দিকে তাকাতেই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। ট্রেনের ভেতরের আবছা আলো-আঁধারিতে, যা ছিল জানালার বাইরে থেকে আসা অস্পষ্ট চাঁদের আলো, তাতে দেখলাম—না, ঠিক দেখলাম না, অনুভব করলাম—অনেকগুলো ছিন্নভিন্ন কাটা মাথা কামরার মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিন্তু সেগুলো শুধু মাথাই ছিল না। সেগুলো যেন সজীব! তাদের নিষ্প্রাণ চোখগুলো যেন নিবদ্ধ ছিল আমাদের দিকে। ট্রেনটি হঠাৎ একটা তীব্র ঝটকা দিয়ে গতি বাড়িয়ে দিল। মনে হলো যেন রকেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। বগির ভেতরে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে—এক ধরনের চাপা গোঙানি, চাপা আর্তনাদ, আর মনে হলো যেন বাতাসে ভেসে আসছে মাংস পচার তীব্র গন্ধের সাথে ধাতব কিছু ঘষা লাগার কর্কশ আওয়াজ।

হঠাৎ করে আমরা দেখলাম, কামরার সিলিং থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে এক গাঢ়, সান্দ্র তরল নামছে। সেটা কি জল? না, সেটা ছিল জমাট বাঁধা রক্তের মতো কিছু, যা ফোঁটা ফোঁটা করে আমাদের ওপর পড়ছে। সিটগুলো যে নরম গদির মতো মনে হচ্ছিল, সেগুলো আসলে ছিল জমাট রক্ত আর মানুষের শরীরের মাংস দিয়ে তৈরি! ছাদের কোণা থেকে একটা ভাঙা আয়নার টুকরোতে আমার চোখ পড়লো। মুহূর্তের জন্য আমি দেখলাম, আমার পাশের সিটে বসে থাকা শাহেদের শরীরটা কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে। তার মুখের ওপর দিয়ে গাঢ় রক্তের ধারা নেমে আসছে। আর তার চোখ দুটো… সেগুলোতে ভয় নেই, আছে কেবল এক গভীর শূন্যতা। আর তার চারপাশের বাতাস যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে অশরীরী চিৎকারে।

আমাদের মনে হলো ট্রেনের গতি আর বাড়ছে। আর সেই সাথে ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে আসছে এক অজানা ভয়ে। সোহেল আর আমি বাকি তিনজনকে কোনোরকমে টেনে ধরে ট্রেনের দরজা লক্ষ্য করে ছুটলাম। একটা তীব্র ঝাঁকুনিতে দরজাটা খুলে গেল। আমরা কিছু না ভেবেই সেই উন্মত্ত গতিতে ছুটে চলা ট্রেন থেকে অন্ধকারে ঝাঁপ দিলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ট্রেনটা এখন কালো ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে, আর তার পিছু পিছু ভেসে আসছে একদল নারীর তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর শিশুদের ভয়ার্ত কান্নার শব্দ। যেন সমস্ত নরক এই ট্রেনেই আটকে আছে। তারপর কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম আর মনে নেই। যখন চোখ খুললাম, দেখি আমি হাসপাতালের বিছানায়। চারপাশে ব্যান্ডেজ আর স্যালাইন। ট্রেনের কথা মনে পড়তেই বুক কেঁপে ওঠে।

সোহেল আর আমি ভাগ্যিস লাফ দিয়েছিলাম। বাকিদের হাত-পা ভেঙে গেছে, কিন্তু সবারই প্রাণ বেঁচেছে। খুব সকালে ক্ষেতে কাজ করতে যাওয়া কয়েকজন কৃষক আমাদের অজ্ঞান অবস্থায় খুঁজে পেয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয় এবং ঢাকায় খবর পাঠায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আব্বু-আম্মু চলে আসবেন। হাসপাতালের নার্স বলল, এই অভিশপ্ত ট্রেনে চড়ে এর আগেও অনেকে নিরুদ্দেশ হয়েছে। আরও শুনলাম, গোয়ালন্দঘাট ট্রেনটি নাকি গত রাতে চিলাহাটিতে লাইনচ্যুত হয়েছিল, তাই সেটি খয়রাত নগর স্টেশনে পৌঁছাতেই পারেনি। তাহলে আমরা কোন ট্রেনে উঠেছিলাম? প্রশ্নের উত্তরটা অজানা রয়ে গেল। শুধু বুকটা কেঁপে উঠল সেই মিষ্টি সুবাস আর কাটা মাথার কথা মনে করে…..

কিছু কিছু ঘটনা সারাজীবন মনে দাগ কেটে রাখে। রাতের নিস্তব্ধতা যখন চারপাশ জুড়ে, সেই স্মৃতিগুলো হঠাৎ কাঁচের মতো খসে পড়ে মনদগ্ধ কক্ষে। গা শিউরে ওঠে, নিঃশ্বাস থেমে যায়। গল্প লিখতে বসলেই হাত কাগজের ওপর স্থির হয়ে যায়, আঙুলগুলো অসাড় হয়ে পড়ে—যেন অতীতের ছায়া নিজেই চেপে ধরে শব্দগুলো। কিন্তু ঠিক সেই শিহরণেই লুকিয়ে থাকে কাহিনির প্রাণ, অদৃশ্য ভয়ের মধ্য দিয়ে লেখা হয়ে ওঠে জীবন্ত।

Share On:



CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
Related Posts
 


0 Responses

Leave a Reply