প্রণয়েরব্যাকুলতা সাদিয়া পর্ব৯
- তুই তাজ ভাইয়াকে কি বলেছিস? ভাইয়া অতটা রেগে কেন গেল?
নীরার প্রশ্নে মৌমিতা উত্তর দিল – আমি শুধু মাত্র উনার বাবা মায়ের কথা জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু এটাই বুঝলাম না তাতে উনি এতটা রেগে কেন গেলেন।
- হয়তো উনার বাবা মা নেই আর তুই তাদের কথা জিজ্ঞেস করে তার পুরোনো কোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছিস তাই এতটা রেগে গেছে।
মৌমিতা আনমনে বলল – হয়তো।
- সে যাই হোক তুই আর ভাইয়ার সামনে যাস না। এমনি ভাইয়া তোর উপরে যে পরিমানে রেগে তোকে সামনে পেলে মেরেই ফেলবে।
চুপসে গেল মৌমিতা। ঠিকই তো , এর আগে একদিন চড় খেয়ে গালে তিনদিন ব্যথা ছিল। কি শক্ত হাত রে বাবা। নিজের অজান্তেই নিজের হাত চলে গেল মৌমিতার গালে।
সারাটা দিন যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলেছে তাজকে। তাজের উপর কোনো রাগ বা অভিমানে নয় ভয়ে। তাজের হিংস্রতা কিছুটা হলেও ভয় পাইয়ে দিয়েছে মৌমিতাকে।
সারাদিন ধরে প্রচন্ড ছটফট করছে তাজ। সকালের ঘটনা মনে উঠতেই নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী লাগছে। সকালে ওভাবে অতটা রেগে যাওয়া ঠিক হয়নি। মৌমিতা তো তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে তার অতীত জানে না। তাহলে মেয়েটার দোষ কোথায়? বিনা দোষেই মেয়েটার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে। সকাল থেকে একটা বারও মৌমিতার দেখা মেলেনি, কানের কাছে বাজেনি মৌমিতার পায়ের নুপূর জোড়া। তাহলে কি মৌমিতা তার সাথে আর কথা বলবে না। আর আসবে না তাজের সামনে? মৌমিতা কি ওকে ঘৃণা করবে? ভালোবাসবে না ওকে? ভিতরটা তিক্ততা আর অস্থিরতায় ভরে যাচ্ছে। নিজের কাছে নিজেকেই তিক্ত লাগছে খুব। এই মুহূর্তে নিজেকে শান্ত করার জন্য মৌমিতাকে তাজের প্রয়োজন, ভীষণ প্রয়োজন।
রাত বাড়ছে, সাথে বাড়ছে অন্ধকারের ঘনত্ব। আকাশে গুরু গুরু ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকে ফিক করে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে । ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। হালকা শীতল বাতাস বইছে। অন্ধকারে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে এটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে মৌমিতার রুমের বারান্দা থেকে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাস করতে করতে হঠাৎই ল্যাম্পপোস্টের দিকে। পরক্ষনেই আকাশ কাঁপানো এক বিদ্যুতের ঝলকানিতে অবয়বটির মুখশ্রী ভেসে উঠলো মৌমিতার চোখের সামনে। আঁতকে উঠলো মৌমিতা। তাজ ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়েই বৃষ্টিতে ভিজছে। আবহাওয়া মোটেও ভালো না। একটু পর পর বাজ পড়ছে। ভাবনা চিন্তার সময় নেই। মৌমিতা দৌড়ে নিচে নেমে গেল, বাড়িটির তিন তলায় একটা রুম নিয়ে থাকে নীরা আর মৌমিতা। তাড়াহুড়োতে ছাতাটা আনতেও মনে নেই। এক দৌড়ে ঝড় বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই দৌড়ে চলে গেল তাজের কাছে। বৃষ্টির শব্দে মৌমিতার নুপূরের রিনিঝিনি শব্দ কানে পৌঁছালো না তাজের। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
- পাগল হয়েছেন? এভাবে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
বৃষ্টির শব্দে মৌমিতার কথাগুলো সম্পূর্ণভাবে কর্নগোচর হলো না তাজের তবে এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে তার পাশে কেউ দাঁড়িয়েছে। করুন চোখে পাশ ফিরে তাকালো তাজ মৌমিতাকে দেখেই হামলে পড়ে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। অপরাধীর সুরে বলল – আই আ’ম স্যরি। আমার ওভাবে রেগে যাওয়া ঠিক হয়নি সকালে। আমার ভুল হয়ে গেছে।
মৌমিতা হতবম্ব। এই লোকটা শুধু মাত্র স্যরি বলার জন্য এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে এই বৈরি আবহাওয়ায় বৃষ্টিতে ভিজছে। স্যরি বলতেই যখন এসেছে ওকে কল করে ডেকে স্যরি বলে চলে যেতে পারতো। এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কি দরকার। মৌমিতা এতটাই হতবাক যে তার কন্ঠনালী থেকে কোনো কথাই বের হচ্ছে না। তাজ আবার করুন কন্ঠে বলল – রেগে আছো আমার উপর তাই না? আমার সামনেও আসতে চাইছো না। তুমিও কি আমায় ঘৃনা করবে মৌ?
তাজের পিঠে হাত রাখলো মৌমিতা। শান্ত কন্ঠে বলল – উহু আমি আপনার উপর একটুও রেগে নেই আর আপনাকে ঘৃনাও করছি না শুধু একটু ভয় পেয়ে ছিলাম।
তাজ আবার অপরাধীর কন্ঠে বলল – স্যরি।
- হয়েছে আর স্যরি বলতে হবে না। এখন বাসায় যান আর বৃষ্টিতে ভিজবেন না জ্বর আসবে।
তাজ গেল না ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। মৌমিতা আবার শুধালো – কি হলো যাচ্ছেন না কেন? শরীর খারাপ করবে তো।
তাজ মৌমিতার হাতটা জাপটে ধরলো একটু নিচু হয়ে মৌমিতার কাধে মাথা রাখলো বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলল – উঁহু যাব না আমি । আজ তোমার সাথে থাকবো।
ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার। অবাক হয়ে আ – এটা কেমন কথা। আমার সাথে থাকবেন মানে কি?
- আমি কিচ্ছু জানি না শুধু জানি তোমার সাথে থাকবো।
তাজ কেমন বাচ্চাদের মতো আচরন করছে। স্বাভাবিক লাগছে না তাকে। ঠিক আছে তো সে । বৃষ্টির দরুন মাথা ঠান্ডা থাকলেও বুকে হাত দিয়ে আতকে উঠলো মৌমিতা। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে তাজের। তাহলে জ্বরের ঘোরেই এমন উল্টো পাল্টা কথা বলছে তাজ। মৌমিতা টেনে হিচরে একটা পরিত্যাক্ত দোকানের ছাউনীর নিচে দাঁড় করালো তাজকে। শাষনের সুরে বলল – শান্ত বাচ্চার মতো এখানেই চুপটি করে দাঁড়াবেন। আমি যাব আর আসবো।
তাজ বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বুঝালো ঠিক আছে। রুমে গিয়ে দ্রুত ভেজা জামা বদলে নিল মৌমিতা। কল লাগালো রাদীফকে। রাদীফ কল রিসিভ করে জানালো সে বৃষ্টিতে আটকে গেছে আজ ফিরতে পারবে না। ধপ করে বসে পড়লো মৌমিতা। এখন উপায়? এভাবে দুটো যুবতী মেয়ের বাসায় একজন পুরুষ মানুষ নিয়ে আসাও সম্ভব নয়। লোকে বদনাম রটাবে। আর মানুষটাকে এই অবস্থায় একা ছেড়েও বা দেয় কিভাবে। দোটানায় ভুগছে মৌমিতা। ক্ষানিক বাদেই উঠে দাঁড়ালো সে। নিজেকে ধাতস্থ করলো, মানবতা সবার আগে। আজ যদি মানুষটাকে এভাবে একা ছেড়ে দেয় আর মানুষটার কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে নিজেকে কোনো দিনই ক্ষমা করতে পারবে না। নীরাও সায় জানালো তার ভাবনার সাথে। আর তাছাড়া সেদিন একা দুটো মেয়েকে পেয়ে যখন কিছু করেনি ছেড়ে দিয়েছে তাহলে এইটুকু বিশ্বাস ভরসা অন্তত তার প্রাপ্প। নিজের পার্স, মোবাইল আর ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মৌমিতা। তাজের কাছে আসতেই তাজ বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বলল – এত দেরী করলে কেন তুমি? আমি ভয় পেয়েছিলাম যে তুমি আর আসবে না।
রাত ১০ টা ছাড়িয়েছে। তার মধ্যে এই বৈরি আবহাওয়া রাস্তায় কাক পক্ষীও দেখা যাচ্ছে না গাড়ি তো দূরের কথা। তাজের বাসা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়। রাদীফ বলল গাড়ি পাঠিয়ে দিবে। কিন্তু গাড়ি কি গাড়ির চাকাও দেখা যাচ্ছে না। মনে মনে ভীষণ বিরক্ত লাগছে আবার হাসিও পাচ্ছে। এই লোক আগে ছিল আগুন চোখা , বদমেজাজি, রাগী আর এখন জ্বরে পড়ে হয়েছে বাচ্চা। মোবাইলটা হাতে নিল তাজের বাচ্চামোগুলো ভিডিও করবে বলে। কিন্তু তা আর হলো না। এর মধ্যেই ওদের সামনে এসে বিশাল এক কালো গাড়ি দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে ছাতা হাতে এক লোক বেড়িয়ে এলো সম্ভবত ড্রাইভার হবে , বলল – রাদীফ স্যার পাঠিয়েছে।
মৌমিতা আর ড্রাইভার টেনে হিচড়ে তাজকে গাড়ির ভিতরে বসালো। বাবাহ তাজের মতো জিম করা বডিওয়ালা লোকের শক্তির সাথে এরা দুজন কি আর পারে। তাজকে তুলতে তুলতে হাঁপিয়ে গেছে দুজনই। ড্রাইভার হাঁপাতে হাঁপাতে বললো – ম্যাম স্যারের কি কিছু হয়েছে?
মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল – স্যার কে?
- তাজ স্যার।
- আপনি উনাকে স্যার বলছেন কেন?
- বারে এই গাড়ি তো উনারই আমি উনার ড্রাইভার।
মৌমিতা গোল গোল চোখে একবার গাড়িটার দিকে তাকালো গাড়িটা বেশ দামী মনে হচ্ছে। সেদিন তাজের বাড়িতেও দেখলো আভিজাত্যের ছোঁয়া। কিন্তু তাজকে দেখে তেমন মনে হয় না। আর তাছাড়া এত বড় গাড়ি থাকতেও তাজ হয় পায় হেঁটে না হয় রিকশায় করে কেন কলেজে যাওয়া আসা করে। কিছুটা কৌতুহল নিয়েই ড্রাইভারকে প্রশ্ন করলো মৌমিতা – আচ্ছা আপনার স্যার কি করেন?
- স্যার তো কিছুই করেন না উনি একজন ছাত্র।
- তাহলে এই বাড়ি গাড়ি ?
- সব উনার বাবার টাকায়।
- উনার বাবা কে?
- আরে আপনি উনার বাবাকে চিনেন না উনার বাবা তো এই শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সাদিক চৌধুরী।
ভ্রু কুঁচকে এলো মৌমিতার। মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো – উনার বাবা কি বেঁচে আছেন? আর উনার মা কোথায়?
- হ্যা বেঁচে আছে তো। আর উনার বাবা মা তো এক সাথেই থাকে।
মনের সন্দেহ বদলে বিষ্ময়ে পরিনত হলো। বাবা মা বেঁচে থাকতেও উনি এটা কেন থাকে? এত বড় ঘরের সন্তান হওয়ার হয়েও এত সাদামাটা চলে কেন? সকালে বাবা মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতে এতটা রেখেই বা গেল কেন? মনের মধ্যে হাজারটা প্রশ্ন কিলবিল কিলবিল করছে। মুখ খুলে ড্রাইভারকে আর কিছু জিজ্ঞাস করার আগেই গাড়ির ভিতর থেকে হাক ছাড়লো তাজ। চিৎকার করে বলে উঠল – তুমি আমায় ধোঁকা দিলে মৌ, আমাকে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দিয়ে তুমি কোথায় চলে গেলে? ও মৌ ও মৌ তুমি কোথায়?
তাজের এমন উদ্ভট কথায় নাক মুখ কুঁচকে এলো মৌমিতার। গাড়ির দরজা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল – কি সমস্যা আপনার?
- তুমি ড্রাইভারের সাথে এত কথা কেন বলছো? ড্রাইভার কি আমার থেকে সুন্দর?
মেজাজ বিগড়ে গেল মৌমিতার, দাঁতে দাঁত চেপে বলল – একদম বাজে কথা বলবেন না । চুপচাপ বসে থাকুন।
তাজ অগ্নী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ড্রাইভারের উপর , চিৎকার করে বলল – শালা বুড়ো হয়েছিস, বা* পেকে গেছে। এখনও আমার অবিবাহিত বউয়ের দিকে নজর দিচ্ছিস। তোকে আমি কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলবো দেখিস।
ধপ করে তাজের পাশে বসে পড়লো মৌমিতা , দাঁত কিড়মিড়ি করে বলল – আপনার বাজে কথা বন্ধ করবেন নাকি?
- তুমি ওভাবে দাঁত কিড়মিড় করছো কেন মৌ পরে যদি ভেঙ্গে যায় তাহলে আমাদের বিয়েতে মাংসের হাড় কিভাবে চিবাবে?
ফিক করে হেসে দিল ড্রাইভার। অগ্নীরূপ ধারন করলো তাজ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল – এই শা’লা ওভাবে হাসছিস কেন? ঐ হাসি দিয়ে আমার অবিবাহিত বউকে পাগল করতে চাইছিস নাকি? আমি বেঁচে থাকতে তোর সেই শখ আমি কোনো দিনই পূরন হতে দেব না।
হাসি বন্ধ হয়ে গেল ড্রাইভারের। মাথা চুলকে গাড়ি স্টার্ট দিল সে। তার স্যার পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি? এভাবে তো কখনও তাকে কথা বলতে শোনেনি। এর আগে হাতে গোনা কয়েকবার দেখা হয়েছে তাজের সাথে। প্রতিবারই গম্ভীর চুপচাপই দেখেছে।
চোখ ঘুরিয়ে মৌমিতার দিকে তাকালো তাজ, বলল – আমার দিকে তাকাও তো মৌ। ঐ ব্যাটার দিকে একদম তাকাবে না। ঐ ব্যাটা তোমাকে পাগল করার ফন্দি আটছে, আমি বুঝিনা ভেবেছে।
চলবে….
পরের পর্বটি পেতে পেইজে ফলো দিয়ে সাথে থাকুন। ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
ধন্যবাদ
Share On:
TAGS: প্রণয়ের ব্যাকুলতা, সাদিয়া
CLICK HERE GO TO OUR HOME PAGE
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩১
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৪
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২২
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ৩৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ১৫
-
প্রণয়ের ব্যাকুলতা পর্ব ২৭